০২:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিশুদের অসংক্রামক রোগ অজানা ঝুঁকির মুখোমুখি বাংলাদেশ

 

  • গবেষণায় শিশুদের অসংক্রামক রোগে উদ্বেগজনক চিত্র
  • শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ছয়টি প্রধান অসংক্রামক রোগ
  • ব্রংকিয়াল অ্যাজমা সর্বোচ্চ, আশঙ্কাজনক হার থ্যালাসেমিয়ায়
  • প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত হচ্ছে সমন্বিত সেবামডেল

    বাংলাদেশে শিশুদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত এক সাম্প্রতিক গবেষণায় এমন কিছু তথ্য ওঠে এসেছে যা অভিভাবক, চিকিৎসক এবং নীতিনির্ধারকদের নতুনভাবে সতর্ক করছে। এই গবেষণা অনুযায়ী দেশে ০-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ছয়টি প্রধান অসংক্রামক রোগ (Non-Communicable Diseases – NCDs) চিহ্নিত করা হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে।
    গবেষণা অনুযায়ী ব্রংকিয়াল অ্যাজমা সবচেয়ে বেশি শিশুদের আক্রান্ত করছে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুর হার ৩৭ শতাংশ। এটি মূলত একটি শ্বাসতন্ত্রজনিত অসুস্থতা, যা শিশুর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, স্কুলে উপস্থিতি, এমনকি স্বাভাবিক খেলাধুলাতেও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
    শিশুদের ফুসফুস তুলনামূলকভাবে সংবেদনশীল হওয়ায় ধুলাবালি, বায়ুদূষণ ও ভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে তারা সহজেই অ্যাজমায় আক্রান্ত হতে পারে।
    গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রংকিয়াল অ্যাজমার পরেই রয়েছে থ্যালাসেমিয়া ও আয়রন ডেফিশিয়েন্সি অ্যানিমিয়া দুই রোগেই আক্রান্ত ২৮ শতাংশ শিশু। এই দুটি রোগ রক্তস্বল্পতা ও রক্ত ঘাটতির সঙ্গে জড়িত এবং নিয়মিত চিকিৎসা ও রক্ত সরবরাহ ছাড়া এসব শিশুদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। এছাড়া ১৯ শতাংশ শিশু জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত। এটি হৃদয়ের গঠনতন্ত্রে ত্রুটি থাকায় রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং অপারেশনসহ জটিল চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। মৃগীরোগে আক্রান্ত ১৪ শতাংশ শিশু; এটি একটি স্নায়ুবিক অসুস্থতা যা সময়মতো নিয়ন্ত্রণ না করলে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। নেফ্রোটিক সিনড্রোম বা কিডনির সমস্যা রয়েছে ২ শতাংশ শিশুর এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ১ শতাংশ।
    ‘ডিজাইনিং অ্যান্ড পাইলটিং পেডিয়াট্রিক এনসিডি সার্ভিস মডেল ফর চিলড্রেন অ্যান্ড এডোলেসেন্টস অ্যাট প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই গবেষণাটি আইসিডিডিআরবি পরিচালনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশের সহযোগিতায়। প্রথম সাত সপ্তাহে ৩৮৫ জন শিশুর অসংক্রামক রোগ নির্ণয় করা হয়। তাদের স্বাস্থ্য অবস্থা পর্যালোচনা করে এ তথ্যগুলো পাওয়া গেছে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, প্রায় ৮ শতাংশ রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত সেবাকেন্দ্রে রেফার করতে হয়েছে, যা এ সমস্যার জটিলতা বোঝায়।
    ২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিশুদের জন্য সংক্রামক নয় এমন দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসায় একটি জাতীয় চিকিৎসাসেবা প্রটোকল গৃহীত হয়। ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এই মডেল কিশোরগঞ্জের ১২টি এবং বাগেরহাটের ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও দুটি জেলা হাসপাতালে কার্যকর করা হয়। এই মডেল অনুযায়ী ০-১৭ বছর বয়সী শিশুদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা একীভূতভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। এতে শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রাথমিক চিকিৎসা, রোগ শনাক্তকরণ এবং রেফারেল ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে।
    ২০১৭ সালে বিশ্বের ২১০ কোটিরও বেশি শিশু অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল এবং মারা গিয়েছিল প্রায় ১০ লাখ শিশু। ২০১৯ সালের গ্লোবাল বার্ডেন রিপোর্টে এই চিত্র উঠে এসেছে। অথচ বাংলাদেশে এই সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য ছিল না এতদিন। তাই আইসিডিডিআরবির এই গবেষণা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয় বরং দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্বাস্থ্যের জন্য এক আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ। গবেষণার প্রধান গবেষক ডা. আলিয়া নাহিদ বলেন, এ গবেষণা বাংলাদেশে শিশুদের এনসিডি চিকিৎসায় একটি টেকসই ও সম্প্রসারণযোগ্য মডেল স্থাপনের ভিত্তি তৈরি করেছে। এই মডেল শুধু শিশুদের বর্তমান স্বাস্থ্য নিশ্চিত করছে না বরং তাদের ভবিষ্যতেও সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে সহায়ক।

জনপ্রিয় সংবাদ

স্মৃতিসৌধে তারেক রহমান

শিশুদের অসংক্রামক রোগ অজানা ঝুঁকির মুখোমুখি বাংলাদেশ

আপডেট সময় : ০৭:৩৫:০২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫

 

  • গবেষণায় শিশুদের অসংক্রামক রোগে উদ্বেগজনক চিত্র
  • শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ছয়টি প্রধান অসংক্রামক রোগ
  • ব্রংকিয়াল অ্যাজমা সর্বোচ্চ, আশঙ্কাজনক হার থ্যালাসেমিয়ায়
  • প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত হচ্ছে সমন্বিত সেবামডেল

    বাংলাদেশে শিশুদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবনার সময় এসেছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) পরিচালিত এক সাম্প্রতিক গবেষণায় এমন কিছু তথ্য ওঠে এসেছে যা অভিভাবক, চিকিৎসক এবং নীতিনির্ধারকদের নতুনভাবে সতর্ক করছে। এই গবেষণা অনুযায়ী দেশে ০-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ছয়টি প্রধান অসংক্রামক রোগ (Non-Communicable Diseases – NCDs) চিহ্নিত করা হয়েছে, যা দীর্ঘমেয়াদে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে পারে।
    গবেষণা অনুযায়ী ব্রংকিয়াল অ্যাজমা সবচেয়ে বেশি শিশুদের আক্রান্ত করছে। এ রোগে আক্রান্ত শিশুর হার ৩৭ শতাংশ। এটি মূলত একটি শ্বাসতন্ত্রজনিত অসুস্থতা, যা শিশুর দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, স্কুলে উপস্থিতি, এমনকি স্বাভাবিক খেলাধুলাতেও বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
    শিশুদের ফুসফুস তুলনামূলকভাবে সংবেদনশীল হওয়ায় ধুলাবালি, বায়ুদূষণ ও ভাইরাস সংক্রমণের প্রভাবে তারা সহজেই অ্যাজমায় আক্রান্ত হতে পারে।
    গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রংকিয়াল অ্যাজমার পরেই রয়েছে থ্যালাসেমিয়া ও আয়রন ডেফিশিয়েন্সি অ্যানিমিয়া দুই রোগেই আক্রান্ত ২৮ শতাংশ শিশু। এই দুটি রোগ রক্তস্বল্পতা ও রক্ত ঘাটতির সঙ্গে জড়িত এবং নিয়মিত চিকিৎসা ও রক্ত সরবরাহ ছাড়া এসব শিশুদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। এছাড়া ১৯ শতাংশ শিশু জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত। এটি হৃদয়ের গঠনতন্ত্রে ত্রুটি থাকায় রক্ত সঞ্চালনে সমস্যা সৃষ্টি করে এবং অপারেশনসহ জটিল চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। মৃগীরোগে আক্রান্ত ১৪ শতাংশ শিশু; এটি একটি স্নায়ুবিক অসুস্থতা যা সময়মতো নিয়ন্ত্রণ না করলে বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। নেফ্রোটিক সিনড্রোম বা কিডনির সমস্যা রয়েছে ২ শতাংশ শিশুর এবং টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ১ শতাংশ।
    ‘ডিজাইনিং অ্যান্ড পাইলটিং পেডিয়াট্রিক এনসিডি সার্ভিস মডেল ফর চিলড্রেন অ্যান্ড এডোলেসেন্টস অ্যাট প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটিস ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এই গবেষণাটি আইসিডিডিআরবি পরিচালনা করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশের সহযোগিতায়। প্রথম সাত সপ্তাহে ৩৮৫ জন শিশুর অসংক্রামক রোগ নির্ণয় করা হয়। তাদের স্বাস্থ্য অবস্থা পর্যালোচনা করে এ তথ্যগুলো পাওয়া গেছে। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, প্রায় ৮ শতাংশ রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত সেবাকেন্দ্রে রেফার করতে হয়েছে, যা এ সমস্যার জটিলতা বোঝায়।
    ২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো শিশুদের জন্য সংক্রামক নয় এমন দীর্ঘমেয়াদি রোগের চিকিৎসায় একটি জাতীয় চিকিৎসাসেবা প্রটোকল গৃহীত হয়। ২০২৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এই মডেল কিশোরগঞ্জের ১২টি এবং বাগেরহাটের ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও দুটি জেলা হাসপাতালে কার্যকর করা হয়। এই মডেল অনুযায়ী ০-১৭ বছর বয়সী শিশুদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা একীভূতভাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রদান করা সম্ভব হয়েছে। এতে শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রাথমিক চিকিৎসা, রোগ শনাক্তকরণ এবং রেফারেল ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে।
    ২০১৭ সালে বিশ্বের ২১০ কোটিরও বেশি শিশু অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল এবং মারা গিয়েছিল প্রায় ১০ লাখ শিশু। ২০১৯ সালের গ্লোবাল বার্ডেন রিপোর্টে এই চিত্র উঠে এসেছে। অথচ বাংলাদেশে এই সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য ছিল না এতদিন। তাই আইসিডিডিআরবির এই গবেষণা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয় বরং দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্বাস্থ্যের জন্য এক আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ। গবেষণার প্রধান গবেষক ডা. আলিয়া নাহিদ বলেন, এ গবেষণা বাংলাদেশে শিশুদের এনসিডি চিকিৎসায় একটি টেকসই ও সম্প্রসারণযোগ্য মডেল স্থাপনের ভিত্তি তৈরি করেছে। এই মডেল শুধু শিশুদের বর্তমান স্বাস্থ্য নিশ্চিত করছে না বরং তাদের ভবিষ্যতেও সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করতে সহায়ক।