- হাজার কোটি টাকার সম্পদ, তবুও দাবি অপরিশোধিত
- পাওনা আদায় করতে গ্রাহকরা ঘুরছে মাসের পর মাস
- সময় ক্ষেপণে গ্রাহকদের ভোগান্তি, হচ্ছে অর্থলোপাট
বিমা খাতে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ অস্থিরতা। বিমা কোম্পানির কাছে হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে। বছরে শতকোটি টাকার প্রিমিয়াম আয়ও হচ্ছে। তার পরও সেসব কোম্পানি থেকে পাওনা আদায় করতে গ্রাহকদের ঘুরতে হচ্ছে মাসের পর মাস। গ্রাহকদের অভিযোগ, পলিসির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিন-চার বছর কেটে গেলেও কোম্পানি থেকে টাকা পাওয়া যায় না। বিমা কোম্পানিগুলো নথিপত্রের ঘাটতি, পুনঃবিমা, সার্ভে রিপোর্ট না পাওয়াসহ নানা ইস্যুতে সময়ক্ষেপণ করে। অনেক ক্ষেত্রে এক কোম্পানির এজেন্ট অন্য কোম্পানিতে চলে যান। সে কারণেও গ্রাহককে ভোগান্তি পোহাতে হয়। এদিকে, বিমা খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রাহকের পাওনা দ্রুত আদায়ে আইডিআরএ সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সম্পদ বিক্রির অনুমোদন দিতে পারে। বিমা আইনে এমন বিধান দেওয়া আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখানে আইনের অনেক দুর্বলতা আছে। কোনো একটি সিদ্ধান্ত কোম্পানির পছন্দ না হলেই তারা আদালতে গিয়ে আদেশ স্থগিত করে নিয়ে আসে। এজন্য এখন নতুন করে আইন করা হচ্ছে। যা বিমা খাতের আস্থা ফেরাতে সহায়ক হবে বলে আশা তাদের।
ইন্স্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি বা আইডিআরএর ২০২৪ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে এমন সাতটি জীবন বিমা কোম্পানি আছে, যাদের নিট সম্পদ হাজার কোটি টাকারও বেশি, তবুও শতভাগ বিমা দাবি পরিশোধ করছে না। মেটলাইফের (পূর্বের আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স) সর্বশেষ নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে এককভাবে ১৯ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকার নিট সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তার পরও কোম্পানিটির কাছে গ্রাহকের পাওনা ৬৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা। অন্যদিকে বাকি ছয়টি কোম্পানির সম্মিলিত নিট সম্পদ প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। সেই কোম্পানিগুলোর কাছে গ্রাহকদের পাওনা ৩ হাজার ৭০ কোটি টাকার বেশি। এদিকে, ২০২৪ সালে দেশের ৪৬টি নন-লাইফ, অর্থাৎ সাধারণ বিমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকের পাওনা ৩ হাজার ৮৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোম্পানিগুলো পরিশোধ করেছে ১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে বছর শেষে অনিষ্পন্ন বা গ্রাহকের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি ২ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকার বিমা দাবি। অন্যদিকে দেশে ৩৫টি জীবন বিমা কোম্পানির কাছে গ্রাহকের অনিষ্পন্ন বিমা দাবির পরিমাণ ৪ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা।
আইডিআরএ তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে ডিসেম্বর পর্যন্ত জেনিথ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে মোট বিমা দাবি ছিল ৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে ৭ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। কোম্পানিটির নিট সম্পদ আছে ৫৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকার। এদিকে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সম্পদ আছে ৪ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকার। অথচ এই কোম্পানির কাছে গ্রাহকদের পাওনা ১৫৮ কোটি টাকা। জীবন বিমা করপোরেশনের সম্পদ আছে ৩ হাজার ১৩৪ কোটি টাকার। কোম্পানিটির কাছে গ্রাহকের বিমা দাবির পরিমাণ ৬৫১ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে ৫৭২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অনিষ্পত্তিকৃত বিমা দাবি ৭৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্সের কাছে নিট সম্পদ আছে ৬ হাজার ৭৯৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকার। কোম্পানিটির কাছে গ্রাহকের বিমা দাবি অনিষ্পন্ন আছে ৯৭ কোটি ২ লাখ টাকা। এছাড়াও মেঘনা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের নিট সম্পদ আছে ১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকার। কোম্পানির কাছে বিমা দাবি আছে ৩৬২ কোটি ১৭ লাখ টাকা। দাবি পরিশোধ করা হয়েছে ৩৬০ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সম্পদ আছে ১১৩ কোটি ৫ লাখ টাকার। কোম্পানিটির কাছে বিমা দাবি আছে ৮৩ কোটি ৮৮ লাখ টাকার, পরিশোধ করা হয়েছে মাত্র ৬ কোটি ২২ লাখ টাকা। প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সম্পদ আছে ২৭৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকার। এই কোম্পানির কাছে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিমা দাবি আছে ২০১ কোটি ৪৯ লাখ টাকার। পরিশোধ করা হয়েছে মাত্র ৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা।
এদিকে, সম্পদ বিক্রি করার বিষয়ে বিমা আইন, ২০১০-এর ২০-এর (২) ধারায় বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ), লিখিত নোটিশে কোম্পানিকে তার পলিসির বিপরীতে পর্যাপ্ত অর্থ ও সম্পদ আছে কি না সে বিষয়ে তথ্য চাইতে পারবে। এবং ৪১-এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোম্পানিগুলোর সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) থাকিব’। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন অনুযায়ী আইডিআরএ কোম্পানির সম্পদ বিক্রির অনুমোদন দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো সম্পদ বিক্রির অনুমোদন পেলেও বিক্রি করতে না পারায় দাবি পরিশোধ করতে পারে না।
এ বিষয়ে বিমা কোম্পানিগুলোর এমডিদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এম নুরুজ্জামান বলেন, কয়েকটি বিমা কোম্পানির কাছে হাজার কোটি টাকার সম্পদ আছে সত্য। কিন্তু এগুলো বিক্রি করাই সমাধান নয়। কারণ সম্পদ বিক্রি করে যদি গ্রাহকের পাওনা টাকা পরিশোধ করতে হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে সেই কোম্পানি চলবে কীভাবে। তবে কোম্পানি যদি দীর্ঘ সময় ধরে গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধ না করে, তাহলে আইডিআরএ অনুমোদন সাপেক্ষে সম্পদ বিক্রির উদ্যোগ নিতে পারে।
এ বিষয়ে আইডিআরএ চেয়ারম্যান ড. এম আসলাম আলম বলেন, এখানে আইনের অনেক দুর্বলতা আছে। আমাদের কোনো একটি সিদ্ধান্ত কোম্পানির পছন্দ না হলেই তারা আদালতে গিয়ে আদেশ স্থগিত করে নিয়ে আসে। আমরা এখন নতুন করে আইন করছি। যেখানে আইডিআরএ গ্রাহকের স্বার্থে যেসব সিদ্ধান্ত নেবে সেগুলোতে যাতে কোম্পানিগুলো আদালতে যেতে না পারে, সে বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিমা খাতেও যাতে যোগ্য নেতৃত্ব আসে সেটিও বিবেচনা করা হচ্ছে। আরও অনেকগুলো বিষয়কে সংশোধন করা হচ্ছে, যা বিমা খাতের আস্থা ফেরাতে সহায়ক হবে।


























