০৬:২০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

টাকা ছাপাতে বছরে খরচ ২০ হাজার কোটি ‘ক্যাশলেস’ লেনদেনের তাগিদ

ছয় মাস না যেতেই ব্যবহারের অনুপোযোগী কাগুজে নোট
কাগুজে নোটে খরচ বেশি, বিকল্প চিন্তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক’র

টাকা ছাপানো ও বিতরণে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গতকাল বুধবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে মাস্টারকার্ড ও আইসিএমএবি আয়োজিত ক্যাশলেস বাংলাদেশ সামিট-২০২৫ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গভর্নর একথা বলেন। এ বিপুল খরচ কমাতে ক্যাশলেস বা নগদবিহীন লেনদেন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। গভর্নর বলেন, দেশে নগদ অর্থের চাহিদা প্রতি বছর প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে টাকা ছাপানো ও বিতরণে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।’
এদিকে মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’কে স্বতন্ত্র বিনিয়োগকারীর কাছে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর। তিনি বলেছেন, নগদ চালানোর মতো সক্ষমতা পোস্ট অফিসের নেই। তাই নগদে নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজতে সপ্তাহখানেকের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। গভর্নর বলেন, ‘আন্ত লেনদেন ব্যবস্থার চালুর বিষয়ে গেটস ফাউন্ডেশনের মোজোলুপের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামী মাসে তারা বাংলাদেশে আসবে। তিনি বলেন, ‘আগের সরকার নিজেদের আত্মীয়-স্বজন দিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান বানিয়েছিলে। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তারাও হারিয়ে গেছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘শিগগিরই বেসরকারি খাতের ক্রেডিট ব্যুরোর জন্য অনুমোদন দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে এ ধরনের ৫টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। আগামীতে যাদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হবে প্রত্যেকে যেন কিউআর কোড থাকে সে ব্যবস্থা করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অমুষ্ঠানে আইসিএমএবির প্রেসিডেন্ট মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন আর্থিক রূপান্তরের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাশলেস অর্থনীতির পথে যাত্রা আর ভবিষ্যতের লক্ষ্য নয়, বরং তা বর্তমানের জরুরি বাস্তবতা। এই সামিটে নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে বাস্তবায়নকারী অংশীদার সবাইকে একই মঞ্চে এনেছে, যা একটি কার্যকর রূপরেখা নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করি।’
নতুন টাকা ছাপাতে সরকারকে প্রতিবছর খরচ করতে হয় মোটা অংকের টাকা। ব্যবহারের পদ্ধতিগত কারণে কাগুজে এসব নোটের স্থায়িত্ব কমছে। ছয় মাস না যেতেই ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে কাগুজে নোট। সে তুলনায় খরচ বেশি হলেও ধাতব কয়েনের স্থায়িত্বও অনেক বেশি। চাহিদা অনুযায়ী প্রতিবছর শুধু নতুন নোট ছাপাতে সরকারের খরচ হয় চার থেকে পাঁচশ কোটি টাকা। খরচে লাগাম টানতে ক্যাশলেস কিউআর (কুইক রেসপন্স) লেনদেনে ঝুঁকছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন আর আগের মতো বেশিদিন টিকছে না টাকা। ছয় মাসেই নষ্ট হচ্ছে কাগুজে নোট। যেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষণ করার পর তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। পুড়িয়ে ফেলা ব্যবহার অযোগ্য নোট ও বাজার সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেই পরে নতুন নোট আনা হয়। অর্থাৎ, নতুন নোট ছাপানো হয়। এক্ষেত্রেও মার্কেট টুলস ব্যবহার করে পর্যালোচনা করে দেখা হয়, কী পরিমাণ নতুন টাকার দরকার পড়ে। সেভাবেই ছাপিয়ে বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে ছাড়া হয়।

কাগুজে নোটে খরচ বেশি পড়ায় বিকল্প চিন্তাও করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ধীরে ধীরে ক্যাশলেসের দিকে এগোচ্ছে আর্থিকখাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এজন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকায় শুরু করা হয়েছে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন। যে মাধ্যমকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে নেওয়া হচ্ছে উদ্যোগ। তবে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেনকে সাধুবাদ জানালেও এ বিষয়ে আরও সচেতন ও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কিউআর কোডের মাধ্যমে সর্বত্র লেনদেনের ধারণা কতটা আছে সেটাও দেখতে হবে। এতেও জালিয়াতি-চুরি হতে পারে। সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন অনেকে। এতে সচতেনতাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। বর্তমান বিশ্বে টাকা ছাপানোর কারখানা রয়েছে মোট ৬৫টি। বাংলাদেশের কারখানাটির নাম টাঁকশাল। টাঁকশালে টাকা ছাপানো শুরুর আগে অন্য দেশ থেকে ছাপানো হতো। এর মধ্যে রয়েছে- সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইংল্যান্ড। টাঁকশালের টাকা ছাপানোর ধাপগুলো খুবই গোপনীয়। সেখানে প্রায় ১২টি ধাপ পেরোতে হয় টাকা তৈরির জন্য। কারখানার অভ্যন্তরে সব কর্মচারীর মোবাইল ফোন কিংবা যে কোনো ধরনের ডিভাইস ব্যবহারও নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালে। এরপর ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ দেশের নিজস্ব কাগুজে মুদ্রা চালু হয়। মানচিত্র খচিত প্রথম নোটটি ছিল এক টাকার। এক টাকার নোটটিতে অর্থসচিব কে এ জামানের স্বাক্ষর ছিল। ১৯৭৩ সালে ৫, ১০ ও ১০০ টাকার নোট ইস্যু করে বাংলাদেশ। এরপর ৫০ ও ৫০০ টাকার নোটের প্রচলন করা হয় ১৯৭৬ সালে। ১৯৭৯ সালে ইস্যু করা হয় ২০ টাকার নোট। দেশে দুই টাকার নোট চালু হয় ১৯৮৮ সালে। ২০০৯ সালের ১৭ জুলাই বাজারে আনা হয় সবচেয়ে বেশি মানের ১০০০ টাকার ব্যাংকনোট। আর ২০২০ সালে সবশেষ বাজারে আসে ২০০ টাকার নোট। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ১০০০ টাকার নোট ছাপাতে ৫ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট ছাপানোয় খরচ পড়ে সাড়ে ৪ টাকা। এছাড়া ২০০ টাকার নোটে তিন টাকার কিছু বেশি, ১০০ টাকার নোটে ৪ টাকা, ১০, ২০, ৫০ টাকার সবগুলো নোটই দেড় টাকা খরচ পড়ে। আর ৫ টাকা, ২ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে প্রায় দেড় টাকা। সবচেয়ে বেশি খরচ পড়ে কয়েন তৈরিতে। প্রতিটি কয়েন তৈরিতে সেই মানের প্রায় সমান সমান টাকা খরচ পড়ে যায়। তবে কয়েনে বেশি অর্থ খরচ পড়লেও টেকসই বেশি। এসব নোট ছাপাতে বছরে বিপুল অংকের অর্থ খরচ হয়। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ক্যাশলেসের দিকে এগোতে চায়।
নতুন নোটের চাহিদা বাড়ে ঈদকেন্দ্রিক। ব্যাংক থেকে চাহিদার ভিত্তিতে নতুন নোট ছাড় করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়ে ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ সবাই নেন নতুন টাকা। ঈদ সালামিতেই বেশি কদর বাড়ে এ নোটের। শুধু ঈদ কেন্দ্র করেই নতুন নোট সরবরাহ করা হয় না, মার্কেটে মানি সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেও ছাড়া হয়। গত বছর ঈদের আগেও প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাড়া হয়েছিল বাজারে। তবে ঈদের আগেই এ নোট ছাপা হয় না। নতুন ছাপানো নোট কারেন্সি সার্কুলেশন ও স্টকে জমা থাকে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ছাড়া হয়, এমনটাই বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কাগজের নোট নষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ টাকার বান্ডিলে পিনআপ করা। এটা শুরু হয় ব্যাংক থেকেই। বিভিন্ন ব্যাংকে টাকার নোটের হিসাব শেষে কর্মকর্তারা পিনআপ করে থাকেন। যদিও ধীরে ধীরে এর পরিবর্তন আসছে। ব্যাংকগুলোতে টাকার বান্ডিলে পিনআপের পরিবর্তে রাবারের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। এরপরে টাকা নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ ইচ্ছামতো ভাঁজ করা। যেমন- বাসের কন্ডাক্টররা আঙুলের ফাঁকে টাকা ভাঁজ করে রাখেন। আবার অনেকে মাটির ব্যাংক কিংবা গাঁটিতে টাকা রাখেন গুটিয়ে। এতে কমে টাকার স্থায়িত্ব। এছাড়া ভেজা হাতে টাকা লেনদেন করা, মুখের লালা লাগিয়ে টাকা গোনা, কলম দিয়ে লেখা প্রভৃতি কারণে টাকা দ্রুত নষ্ট হয়।
রাজধানীর ভিক্টর পরিবহনে নিয়মিত বসুন্ধরা থেকে পল্টনে চলাচল করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আহমেদ। কাগুজে নোটের বিষয়ে আলাপ করতেই তিনি বলেন, আমরা কারণে-অকারণে নোটের ক্ষতি করি। সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় বাস বা হিউম্যানহলার (লেগুনা) হেলপারের ইচ্ছামতো ভাঁজের কারণে। তারা নতুন বা পুরোনো টাকার বড় নোটগুলো ভাঁজ করে আলাদা রাখে। এতেই নোটের ক্ষতি শুরু।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই টাকা ছাপাবে, সে সুযোগ নেই। এর সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, সেগুলো মেনেই কাজ করতে হয়। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে অর্থনীতির ওপর। বাজারে অর্থের প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে বাড়িয়ে দেবে জীবনযাত্রার খরচ। এ কারণে অর্থনীতির স্বার্থেই ভারসাম্য রাখতে হয়- এমনটাই বলছেন অর্থনীতিবিদরা। দেশে ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন ক্রমেই বাড়ছে। ক্রেডিট কার্ডের চাহিদাও বেড়েই চলেছে। দেশে বছরে কার্ডে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) মেশিনেও বেড়েছে লেনদেন। বর্তমানে ৮৩ হাজার পিওএসে লেনদেন হচ্ছে বছরে ২৭ হাজার কোটি টাকা। এখন অনলাইনভিত্তিক লেনদেন বছরে ৮০ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ২৭ হাজার কোটি টাকা পিওএসে, আর ৫৩-৫৪ হাজার কোটি টাকা মোবাইল ফোন থেকে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন।

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

টাকা ছাপাতে বছরে খরচ ২০ হাজার কোটি ‘ক্যাশলেস’ লেনদেনের তাগিদ

আপডেট সময় : ০৭:২০:১২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ অগাস্ট ২০২৫

ছয় মাস না যেতেই ব্যবহারের অনুপোযোগী কাগুজে নোট
কাগুজে নোটে খরচ বেশি, বিকল্প চিন্তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক’র

টাকা ছাপানো ও বিতরণে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। গতকাল বুধবার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে মাস্টারকার্ড ও আইসিএমএবি আয়োজিত ক্যাশলেস বাংলাদেশ সামিট-২০২৫ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গভর্নর একথা বলেন। এ বিপুল খরচ কমাতে ক্যাশলেস বা নগদবিহীন লেনদেন বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। গভর্নর বলেন, দেশে নগদ অর্থের চাহিদা প্রতি বছর প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। এই চাহিদা মেটাতে গিয়ে টাকা ছাপানো ও বিতরণে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।’
এদিকে মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’কে স্বতন্ত্র বিনিয়োগকারীর কাছে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন গভর্নর। তিনি বলেছেন, নগদ চালানোর মতো সক্ষমতা পোস্ট অফিসের নেই। তাই নগদে নতুন বিনিয়োগকারী খুঁজতে সপ্তাহখানেকের মধ্যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে। গভর্নর বলেন, ‘আন্ত লেনদেন ব্যবস্থার চালুর বিষয়ে গেটস ফাউন্ডেশনের মোজোলুপের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আগামী মাসে তারা বাংলাদেশে আসবে। তিনি বলেন, ‘আগের সরকার নিজেদের আত্মীয়-স্বজন দিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান বানিয়েছিলে। সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে তারাও হারিয়ে গেছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘শিগগিরই বেসরকারি খাতের ক্রেডিট ব্যুরোর জন্য অনুমোদন দেওয়া হবে। প্রাথমিকভাবে এ ধরনের ৫টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়ার বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। আগামীতে যাদের ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হবে প্রত্যেকে যেন কিউআর কোড থাকে সে ব্যবস্থা করার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। অমুষ্ঠানে আইসিএমএবির প্রেসিডেন্ট মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন আর্থিক রূপান্তরের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাশলেস অর্থনীতির পথে যাত্রা আর ভবিষ্যতের লক্ষ্য নয়, বরং তা বর্তমানের জরুরি বাস্তবতা। এই সামিটে নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে বাস্তবায়নকারী অংশীদার সবাইকে একই মঞ্চে এনেছে, যা একটি কার্যকর রূপরেখা নির্ধারণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশা করি।’
নতুন টাকা ছাপাতে সরকারকে প্রতিবছর খরচ করতে হয় মোটা অংকের টাকা। ব্যবহারের পদ্ধতিগত কারণে কাগুজে এসব নোটের স্থায়িত্ব কমছে। ছয় মাস না যেতেই ব্যবহারের অনুপোযোগী হয়ে পড়ছে কাগুজে নোট। সে তুলনায় খরচ বেশি হলেও ধাতব কয়েনের স্থায়িত্বও অনেক বেশি। চাহিদা অনুযায়ী প্রতিবছর শুধু নতুন নোট ছাপাতে সরকারের খরচ হয় চার থেকে পাঁচশ কোটি টাকা। খরচে লাগাম টানতে ক্যাশলেস কিউআর (কুইক রেসপন্স) লেনদেনে ঝুঁকছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন আর আগের মতো বেশিদিন টিকছে না টাকা। ছয় মাসেই নষ্ট হচ্ছে কাগুজে নোট। যেগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকে সংরক্ষণ করার পর তা পুড়িয়ে ফেলা হয়। পুড়িয়ে ফেলা ব্যবহার অযোগ্য নোট ও বাজার সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেই পরে নতুন নোট আনা হয়। অর্থাৎ, নতুন নোট ছাপানো হয়। এক্ষেত্রেও মার্কেট টুলস ব্যবহার করে পর্যালোচনা করে দেখা হয়, কী পরিমাণ নতুন টাকার দরকার পড়ে। সেভাবেই ছাপিয়ে বাজারের চাহিদার ভিত্তিতে ছাড়া হয়।

কাগুজে নোটে খরচ বেশি পড়ায় বিকল্প চিন্তাও করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ধীরে ধীরে ক্যাশলেসের দিকে এগোচ্ছে আর্থিকখাতের এ নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এজন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকায় শুরু করা হয়েছে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন। যে মাধ্যমকে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে নেওয়া হচ্ছে উদ্যোগ। তবে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেনকে সাধুবাদ জানালেও এ বিষয়ে আরও সচেতন ও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কিউআর কোডের মাধ্যমে সর্বত্র লেনদেনের ধারণা কতটা আছে সেটাও দেখতে হবে। এতেও জালিয়াতি-চুরি হতে পারে। সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছেন অনেকে। এতে সচতেনতাকেই বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। বর্তমান বিশ্বে টাকা ছাপানোর কারখানা রয়েছে মোট ৬৫টি। বাংলাদেশের কারখানাটির নাম টাঁকশাল। টাঁকশালে টাকা ছাপানো শুরুর আগে অন্য দেশ থেকে ছাপানো হতো। এর মধ্যে রয়েছে- সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইংল্যান্ড। টাঁকশালের টাকা ছাপানোর ধাপগুলো খুবই গোপনীয়। সেখানে প্রায় ১২টি ধাপ পেরোতে হয় টাকা তৈরির জন্য। কারখানার অভ্যন্তরে সব কর্মচারীর মোবাইল ফোন কিংবা যে কোনো ধরনের ডিভাইস ব্যবহারও নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭১ সালে। এরপর ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ দেশের নিজস্ব কাগুজে মুদ্রা চালু হয়। মানচিত্র খচিত প্রথম নোটটি ছিল এক টাকার। এক টাকার নোটটিতে অর্থসচিব কে এ জামানের স্বাক্ষর ছিল। ১৯৭৩ সালে ৫, ১০ ও ১০০ টাকার নোট ইস্যু করে বাংলাদেশ। এরপর ৫০ ও ৫০০ টাকার নোটের প্রচলন করা হয় ১৯৭৬ সালে। ১৯৭৯ সালে ইস্যু করা হয় ২০ টাকার নোট। দেশে দুই টাকার নোট চালু হয় ১৯৮৮ সালে। ২০০৯ সালের ১৭ জুলাই বাজারে আনা হয় সবচেয়ে বেশি মানের ১০০০ টাকার ব্যাংকনোট। আর ২০২০ সালে সবশেষ বাজারে আসে ২০০ টাকার নোট। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ১০০০ টাকার নোট ছাপাতে ৫ টাকা ও ৫০০ টাকার নোট ছাপানোয় খরচ পড়ে সাড়ে ৪ টাকা। এছাড়া ২০০ টাকার নোটে তিন টাকার কিছু বেশি, ১০০ টাকার নোটে ৪ টাকা, ১০, ২০, ৫০ টাকার সবগুলো নোটই দেড় টাকা খরচ পড়ে। আর ৫ টাকা, ২ টাকার নোট ছাপাতে খরচ পড়ে প্রায় দেড় টাকা। সবচেয়ে বেশি খরচ পড়ে কয়েন তৈরিতে। প্রতিটি কয়েন তৈরিতে সেই মানের প্রায় সমান সমান টাকা খরচ পড়ে যায়। তবে কয়েনে বেশি অর্থ খরচ পড়লেও টেকসই বেশি। এসব নোট ছাপাতে বছরে বিপুল অংকের অর্থ খরচ হয়। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ক্যাশলেসের দিকে এগোতে চায়।
নতুন নোটের চাহিদা বাড়ে ঈদকেন্দ্রিক। ব্যাংক থেকে চাহিদার ভিত্তিতে নতুন নোট ছাড় করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময়ে ব্যবসায়ী থেকে সাধারণ মানুষ সবাই নেন নতুন টাকা। ঈদ সালামিতেই বেশি কদর বাড়ে এ নোটের। শুধু ঈদ কেন্দ্র করেই নতুন নোট সরবরাহ করা হয় না, মার্কেটে মানি সার্কুলেশন বা অর্থের প্রবাহের বিষয়টি দেখেও ছাড়া হয়। গত বছর ঈদের আগেও প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাড়া হয়েছিল বাজারে। তবে ঈদের আগেই এ নোট ছাপা হয় না। নতুন ছাপানো নোট কারেন্সি সার্কুলেশন ও স্টকে জমা থাকে। বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ছাড়া হয়, এমনটাই বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কাগজের নোট নষ্ট হওয়ার প্রধান কারণ টাকার বান্ডিলে পিনআপ করা। এটা শুরু হয় ব্যাংক থেকেই। বিভিন্ন ব্যাংকে টাকার নোটের হিসাব শেষে কর্মকর্তারা পিনআপ করে থাকেন। যদিও ধীরে ধীরে এর পরিবর্তন আসছে। ব্যাংকগুলোতে টাকার বান্ডিলে পিনআপের পরিবর্তে রাবারের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। এরপরে টাকা নষ্ট হওয়ার অন্যতম কারণ ইচ্ছামতো ভাঁজ করা। যেমন- বাসের কন্ডাক্টররা আঙুলের ফাঁকে টাকা ভাঁজ করে রাখেন। আবার অনেকে মাটির ব্যাংক কিংবা গাঁটিতে টাকা রাখেন গুটিয়ে। এতে কমে টাকার স্থায়িত্ব। এছাড়া ভেজা হাতে টাকা লেনদেন করা, মুখের লালা লাগিয়ে টাকা গোনা, কলম দিয়ে লেখা প্রভৃতি কারণে টাকা দ্রুত নষ্ট হয়।
রাজধানীর ভিক্টর পরিবহনে নিয়মিত বসুন্ধরা থেকে পল্টনে চলাচল করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আহমেদ। কাগুজে নোটের বিষয়ে আলাপ করতেই তিনি বলেন, আমরা কারণে-অকারণে নোটের ক্ষতি করি। সবচেয়ে বেশি নষ্ট হয় বাস বা হিউম্যানহলার (লেগুনা) হেলপারের ইচ্ছামতো ভাঁজের কারণে। তারা নতুন বা পুরোনো টাকার বড় নোটগুলো ভাঁজ করে আলাদা রাখে। এতেই নোটের ক্ষতি শুরু।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেই টাকা ছাপাবে, সে সুযোগ নেই। এর সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, সেগুলো মেনেই কাজ করতে হয়। পুরো বিষয়টি নির্ভর করে অর্থনীতির ওপর। বাজারে অর্থের প্রবাহ বেড়ে গেলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে। এতে দ্রব্যমূল্য বেড়ে বাড়িয়ে দেবে জীবনযাত্রার খরচ। এ কারণে অর্থনীতির স্বার্থেই ভারসাম্য রাখতে হয়- এমনটাই বলছেন অর্থনীতিবিদরা। দেশে ডিজিটাল মাধ্যমে লেনদেন ক্রমেই বাড়ছে। ক্রেডিট কার্ডের চাহিদাও বেড়েই চলেছে। দেশে বছরে কার্ডে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। পয়েন্ট অব সেলস (পিওএস) মেশিনেও বেড়েছে লেনদেন। বর্তমানে ৮৩ হাজার পিওএসে লেনদেন হচ্ছে বছরে ২৭ হাজার কোটি টাকা। এখন অনলাইনভিত্তিক লেনদেন বছরে ৮০ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ২৭ হাজার কোটি টাকা পিওএসে, আর ৫৩-৫৪ হাজার কোটি টাকা মোবাইল ফোন থেকে কিউআর কোডের মাধ্যমে লেনদেন।