- নিরাপদ করার কার্যক্রম দুই বছর ধরে স্থবির
- এক হাজার ৩৯৭টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ কারখানা
- মানদণ্ডে ৫৭টি কারখানা শতভাগ নিরাপদ
- ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ কারখানার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে
দেশে অগ্নিদুর্ঘটনাসহ বৈদ্যুতিক ও ভবনের স্ট্রাকচারাল (গঠনজনিত) দুর্ঘটনার ‘অতি (উচ্চ) ঝুঁকিতে’ রয়েছে, এমন প্রায় ৮৫০টি কারখানা চিহ্নিত করেছিল সরকার। তবে সমন্বয়ের অভাব ও প্রাতিষ্ঠানিক অনীহার কারণে গত দুই বছর ধরে দেশব্যাপী এই পর্যবেক্ষণ ও নিরাপত্তা উদ্যোগ কার্যত স্থবির হয়ে আছে। বিস্তৃত এই কর্মসূচির নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) শুরুতে সমন্বয়ের দায়িত্ব নিলেও এখন তা ছাড়তে চাইছে। সংস্থাটি বলছে, বিষয়টি তাদের মূল দায়িত্বের আওতায় পড়ে না এবং এটি সামাল দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় জনবলও তাদের নেই। দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমিক সংগঠনের প্ল্যাটফর্ম ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল এর সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার জানান, কারখানাগুলো এখনও নিরাপদ না হওয়ার সবচেয়ে বড় দায় সরকারের। তিনি আরও বলেন, নিরাপত্তা তদারককারী সংস্থাগুলো দুর্নীতিগ্রস্ত, তাদের মধ্যে স্বচ্ছতার এবং জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। এ কারণেই এসব কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পরও লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার বা নিরাপত্তা নিশ্চিতে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। ২০২১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এর নির্দেশে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) কে কারখানা নিরাপত্তা কার্যক্রমের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে এখন সংস্থাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা আর এ সমন্বয়কারীর দায়িত্বে থাকতে চায় না। গত সপ্তাহে এক অনুষ্ঠানে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, এটা মূলত কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডাইফ)-এর কাজ ছিল। আমরা এখন এ কাজ ছেড়ে দিয়েছি। এটি বিডার দায়িত্ব নয়। তিনি বলে, এই কাজ পরিচালনার জন্য বিডার প্রয়োজনীয় জনবলও নেই। এটি আমার মূল দায়িত্বের (কোর ফোকাস) বাইরে, তাই আমি ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছি এই কাজ বিডা করবে না।
নারায়ণগঞ্জের হাশেম ফুডস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫০ জনের বেশি শ্রমিকের প্রাণহানির পর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সমন্বয়ে ২০২২ ও ২০২৩ সালে দুই দফায় ১০ হাজারের বেশি কারখানা পরিদর্শন করে এসব কারখানাকে ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিডার নেতৃত্বে পরিচালিত সমন্বিত পরিদর্শনের মাধ্যমে ৮৪৮টি ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ ও ১,৩৯৭টি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ কারখানা মিলিয়ে মোট ২,২৪৫টি দুর্বল কারখানাকে চিহ্নিত করা হয়। এ পরিদর্শন কার্যক্রমে ৭টি সরকারি সংস্থা অংশ নেয়, যার মধ্যে ছিল শ্রম পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, এবং বিস্ফোরক অধিদপ্তর। কারখানাগুলোকে ৪টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়—অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, কম ঝুঁকিপূর্ণ ও নিরাপদ। পরিদর্শন তালিকার মানদণ্ডে শতভাগ নম্বর পেয়ে মাত্র ৫৭টি কারখানাকে সম্পূর্ণ নিরাপদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে এসব কারখানাকে নিরাপদ করার পরবর্তী কাজ—অর্থাৎ সংশোধনমূলক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়ন তদারকি—প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। শ্রম মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চিহ্নিত কারখানাগুলোর বেশিরভাগই স্থানীয় ও অ-রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক কারখানা, পাশাপাশি অন্যান্য স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানও এর অন্তর্ভুক্ত। তিনি বলেন, শ্রম পরিদর্শন অধিদপ্তর ও ফায়ার সার্ভিস কিছু কারখানার জন্য কারেকটিভ অ্যাকশন প্ল্যান (সংশোধনমূলক কর্মপরিকল্পনা) তৈরি ও তদারকির কাজ করেছে, তবে অন্যান্য সংস্থাগুলো খুব একটা কাজ করেনি। মোটের ওপর কারখানাগুলোকে নিরাপদ করার ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। গত দুই বছর ধরে পুরো কর্মসূচিই স্থবির অবস্থায় আছে। এছাড়া দুই বছর আগে চিহ্নিত করা আরও ২,৯০০ কারখানার পরিদর্শনের পরিকল্পনাও এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। এতে উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ কারখানার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। গত দুই সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে একের পর এক বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিষয়গুলো আবারও আলোচনায় এসেছে। শ্রমিক অধিকারকর্মীরা বলছেন, বড় কোনো দুর্ঘটনার পরই এমন নিরাপত্তা কার্যক্রম শুরু হয়, কিন্তু কিছুদিন পরই তা গতি হারায়। তাদের মতে, এই পুনরাবৃত্ত ব্যর্থতার মূল কারণ হলো সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা। শ্রম পরিদর্শন অধিদপ্তর এর মহাপরিদর্শক ওমর মো. ইমরুল মোহসিন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আমরা শুনেছি বিডা আর নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকতে চায় না। হয়তো শ্রম মন্ত্রণালয় এ কার্যক্রমের তদারকির দায়িত্ব নিতে পারে এমন পরিকল্পনা থাকতে পারে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর–এর সাবেক মহাপরিচালক আলী বলেন, প্রাসঙ্গিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, সীমিত সক্ষমতা ও পর্যাপ্ত ক্ষমতার ঘাটতিই মূলত এসব কারখানাকে নিরাপদ করতে না পারার প্রধান কারণ।


























