লোকমান আপন
গত বছর সেপ্টেম্বরে নেদারল্যান্ড থেকে বাসে করে প্যারিসে ফিরছিলাম। বিকেলের দিকে বাস বেলজিয়াম ক্রস করে ফ্রান্স সীমান্তে ঢুকেছে এমন সময় সাবের ফোন এলো। ফ্রান্সবাসী আমার এ বন্ধুটির সঙ্গে অনেক দিন দেখা নেই, ফোনেও কথা হয়নি বেশ কিছুদিন ধরে। অনেক দিন পর ফোন পেয়ে যোগাযোগ কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সাব বলল, আমি তো প্যারিসের বাইরে চলে এসেছি। আমি জানতে চাইলাম প্যারিসের বাইরে সেকোনো কাজে গেছে কি না? উত্তরে সাব বলল, সে একেবারেই চলে গেছে প্যারিস ছেড়ে। এখন থেকে সে প্যারিসের বাইরেই স্থায়ীভাবে বসবাস করবে। সাবের প্যারিস ছেড়ে চলে যাওয়ার খবরে আমার কিছুটা মন খারাপ হলেও ভেতরে ভেতরে আমি কিছুটা খুশি হয়েছি। খুশি হওয়ার কারণ হলো, আমার আরেকটি বেড়ানোর জায়গা তৈরি হলো। ফ্রান্সের একেবারে উত্তরে বেলজিয়ামের সীমান্তবর্তী একটি ছোট্ট শহর হচ্ছে ফুখমি (Fourmies) । ফরাসিতে ফুখমি অর্থ হচ্ছে পিঁপড়া। পিঁপড়া নামের এ শহরে সাব একটি বাসা ভাড়া নিয়েছে। আপাতত একা থাকছে, কিছুদিনের মধ্যে তার স্ত্রীও বাংলাদেশ থেকে চলে আসবে। সাব আমাকে ফুখমি ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলল, শহরটি খুব সুন্দর আর নিরিবিলি, তোমার অনেক ভালো লাগবে এখানে এলে। আমি একসময় ফুখমি ভ্রমণে যাব বলে সাবকে কথা দিলাম। এরপর যাই যাচ্ছি করে করে আর সময় হয়ে উঠছিল না। এরই মধ্যে সাবের স্ত্রী হাবিবাও চলে এসেছে বাংলাদেশ থেকে। সেই সঙ্গে ইউরোপে চলে এসেছে গরম এবং ভ্রমণের মৌসুমও। আমি সিন্ধান্ত নিলাম আমার এবারের দূরের ভ্রমণ আমি পিঁপড়া দিয়েই শুরু করব।
সাবের সঙ্গে কথা বলে দিন তারিখ ঠিক করে প্রস্তুতি নিলাম পিঁপড়ায় যাওয়ার। সাব জানাল, কাজ থেকে সে চার দিনের ছুটি নিয়েছে। শনিবার সকালে জরুরি কিছু কাজে সে প্যারিসে আসবে। সেদিনই বিকেলের ট্রেনে আমাকে সঙ্গে নিয়ে সে ফুখমি ফিরবে। সেই কথামতো প্যারিসের ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক ট্রেন স্টেশন গাখ দু নখদ বা পাখি নখদ থেকে পাঁচটা উনিশের ট্রেনে আমরা পিঁপড়ার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে বিকেলের মিষ্টি রোদ এসে বারবার দুষ্টমি করে ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছিল চোখেমুখে। ট্রেনের জানালা দিয়ে চারপাশের নান্দনিক ফ্রান্স দেখতে দেখতে একসময় ট্রেন অনুয়ায় এমোখিতে পৌছে। এখানকার ট্রানজিটে চল্লিশ মিনিটের যাত্রাবিরতি শেষে অন্য আরকেটি ট্রেনে করে প্যারিস থেকে প্রায় তিন ঘণ্টায় ২৪৫ কিলোমিটার দূরের শহর পিঁপড়াতে এসে পৌঁছালাম। পিঁপড়া ট্রেন স্টেশনটি একদম নিরিবিলি আর শান্ত। স্টেশন থেকে বের হয়ে টের পাই আসলেই অনেক শান্ত আর নিরিবিলি এ শহর। দিনের রোদ তখনও জ্বলজ¦ল করছে, রাত হতে এখনো অনেক বাকি। দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে গেছে এরই মধ্যে, রাস্তায় লোকজনও নেই। এখানকার লোকজন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্ততি নিচ্ছে হয়তো। রাস্তায় গাড়ির বাড়াবাড়ি নেই। আমরা বিশ মিনিট পায়ে হেঁটে সাবের বাসায় পৌঁছাই। এখানে ট্রাম কিংবা মেট্রোরেল নেই। টাউন বাস থাকলেও তা এক ঘণ্টা পর পর। এখানকার বেশির ভাগ মানুষের নিজেদের গাড়ি আছে। যাদের গাড়ি নেই তারাও এক ঘণ্টা বাসের অপেক্ষা না করে পায়ে হেঁটেই চলাফেরা করে। ফুখমিতে বেড়ানোর সময় দেখেছি চলন্ত টাউন বাসে মাত্র একজন বা দুজন যাত্রি। আবার কোনো কোনো বাস বাসে যাত্রীও থাকে না। বাসস্টপগুলো নীরবে সুনসান দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে বাসের জন্যে অপেক্ষমাণ কোনো যাত্রীকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখিনি।
পরদিন সকালে পিঁপড়ার রাস্তায় নেমেই হাঁটা শুরু করি ঘুরে দেখার জন্য। মাত্র বাইশ স্কয়ার কিলোমিটারের এ প্রাচীন শহরটি নানা ইতিহাস-ঐতিহ্যের সাক্ষী। কালের বিবর্তনে শহরটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখানকার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে লেসেতো দে মোয়ান বা সন্ন্যাসীদের পুকুর। পুকুরগুলো এত বিশাল যে প্রাথমিকভাবে এগুলো দেখে লেক মনে হয়। কিছুদূর হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের পাড় দেখার পর বেুাঝা যায় এগুলো লেক নয়, আসলেই পুকুর। পর পর চারটি বড় বড় পুকুর শহরের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে গভীর জঙ্গলের ভেতর চলে গেছে।
১৬৯৬ সালে এখানকার স্থানীয় সন্ন্যাসী বা ভিক্ষুরা এ চারটি পুকুর খনন করেছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল পানির অভাব পূরণ করা। পুকুরগুলো বিশাল বড় একটি বনাঞ্চলের ভেতরে অবস্থিত। ৮৭১ হেক্টরের এ বিশাল বনাঞ্চলে রয়েছে নানা জাতের গাছগাছালি ও পশুপাখি। এ বনাঞ্চলের কিছু অংশ ফ্রান্সে পড়েছে আর কিছু অংশ পড়েছে বেলজিয়ামে। গভীর বনাঞ্চলের ভেতরে হওয়ায় বিশাল এ পুকুরগুলো প্রকৃতিপাগল মানুষের কাছে সৌন্দর্যের এক চরম আকর্ষণ হয়ে আছে। তৎকালীন ভিক্ষুরা পুকুরগুলো খনন করেছিলেন সুপেয় পানির অভাব পূরণ করার জন্য। তবে বিভিন্ন সময় এ পুকুরগুলো আরো অনেক কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, স্পিনিং মিলের পানি সরবরাহ, মাছ চাষ, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা ইত্যাদি। এ গহিন বন এবং পুকুরগুলোকে কেন্দ্র করে পরবর্তী সময়ে পর্যটকদের জন্য এখানে করা হয়েছে নানা রকম আকর্ষণীয় ব্যবস্থা। প্রতিবছর গ্রীষ্ম মৌসুমে ফ্রান্স এবং আশপাশের দেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক এ পুকুর এবং বনাঞ্চল ভ্রমণ করতে আসেন। প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমকে সামনে রেখে এখানে করা হয় বাড়তি আয়োজন। দূর-দূরান্ত থেকে অনেকে এখানে ক্যাম্পিং করতে আসেন। তখন পুকুরে সাঁতারের ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি পুকুরপাড়কে বিশাল সৈকতের মতো করে গড়ে তোলা হয়। পুকুরের দুই পাড়ের বড় বড় গাছের সঙ্গে শক্ত তার বেঁধে দিয়ে ঝুলে ঝুলে পুকুরের এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে যাওয়ার ব্যবস্থা, রশি দিয়ে বনের ভেতরে ঝুলন্ত সেতুসহ পর্যটকদের জন্য রয়েছে নানা বাড়তি আকর্ষণ। গ্রীষ্মকালে পিঁপড়া শহর হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে গমগম করতে থাকে। গভীর বনাঞ্চলের ভেতরে রয়েছে উন্মুক্ত ফ্রি জিম, ট্র্যাকিং, সাইক্লিংসহ নানা আয়োজন।
পুকুরের দুই পাড়ে অসংখ্য মানুষ বড়শি দিয়ে মাছ শিকার করছেন। হাঁটতে হাঁটতে পাখির কলতান, বুনো গন্ধ আর পুকুরের সৌন্দর্যে চরমভাবে বিমোহিত হচ্ছিলাম আমি। গভীর বনাঞ্চলে হাঁটার, দৌড়ানোর, বসার, মাছ ধরার, শরীর চর্চা করার, সাইক্লিং করা, পুকুরে নৌকা ভ্রমণসহ দারুণ সব আয়োজন রয়েছে এখানে। খাবারদাবার এবং আবাসিক হোটেলের ব্যবস্থাও আছে।
সন্ন্যাসীদের পুকুরগুলোর পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করেছি অনেক দূর পর্যন্ত। বিশাল এ বনের পাখির কলতান আর স্নিগ্ধ ছায়া সব অবসাদ মুছিয়ে দিয়েছে। জায়গায় জায়গায় বোর্ডে লেখা রয়েছে স্থানের বিবরণ, লোকেশন ম্যাপ এবং ঘুরে দেখার নিয়ম-কানুন। পুকুরের দুই পাড় এবং গভীর জঙ্গলে অসংখ্য মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছেও কেউ কেউ। কেউ কেউ আবার সাইকেল নিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে গহিন বনের ভেতরে। পাশ দিয়ে যাওয়া-আসার সময় সবাই সবাইকে হ্যালো বা বুজু বলছে। সবাই কথা বলছে খুব আস্তে আস্তে। জোরে কথা বললে হয়তো প্রকৃতির ঘুম ভেঙে যেতে পারে। বনের পশুপাখি কিংবা পুকুরের মাছেরা যাতে বিরক্ত না হয়ে সে জন্য সবাই খুব সচেতন এখানে। মায়াময় জঙ্গল আর সন্ন্যাসীদের পুকুরে কয়েক ঘণ্টা ঘুরেছি। প্রচীন এ ফুখমি বা পিঁপড়া হচ্ছে একটি ঐতিহাসিক শহর। যেখানকার প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে নানা কাহিনি। এটি একটি শিল্প শহরও। প্রচীনকাল থেকেই এখানে টেক্সটাইল মিল, কাচের ফ্যাক্টরি, নানা কৃষিখামার গড়ে উঠেছিল। এ জন্য বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন সময় ফুখমিকে দখল করে রেখেছিল। সর্বশেষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকান সৈন্যদের সহায়তায় ফুখমি জার্মানদের কাছ থেকে মুক্ত হয় এবং স্থায়ীভাবে ফ্রান্সের দখলে আসে। এ শহরে রয়েছে অনেক আমেরিকানের বসবাস। ফুখমি এবং এর আশপাশে রয়েছে আরো অনেক আকর্ষণ। সেখানকার আরেকটি আকর্ষণ হচ্ছে- আভেনোয়া ইকো মিউজিয়াম। এ জাদুঘরে রয়েছে এখানকার প্রচীন সব শিল্প-কারখানার ইতিহাস এবং যন্ত্রপাতি। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় চোখে পড়ল একটি বাড়ির গেটে লেখা ভন্দখ দেসো বা ডিম বিক্রি। এ বাসায় পালিত হাঁস-মুরগির ডিম বিক্রি করা হয়। একটু দূরেই চোখে পড়লও আরেকটি বাড়িতে বেশ বড় একটি খামার। যেখানে হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়া পালন এবং বিক্রি করা হয়। পিঁপড়ার রাস্তায় হাঁটার সময় এ রকম ইন্টারেস্টিং আরো অনেক কিছু চোখে পড়ে, যা প্যারিস শহরে সচরাচর দেখা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে কোনো গাদাগাদি বাড়ি বা হাইরাইজ কোনো বিল্ডিং নেই। রাস্তায় বেরোলেই লোকজনের হাসিমাখা বুজু বা হ্যালো শুনে আর সবার আন্তরিক চাহনি দেখে মনে হয় এখানে সবাই সবার আপনজন। হাঁটার সময় দেখা হলেই সবাই সবাইকে হ্যালো বা বুজু বলে। যেন সবাই সবার চেনা। শান্তিপূর্ণ এ শহরে সবাই খুব আন্তরিক আর চেনাজানা। শান্তির শহরে ঘুরে ফিরে সাব এবং তার স্ত্রী হাবিবার আন্তরিক আতিথিয়েতায় নিমেষেই পার হয়ে গেল কয়েকটা দিন। ফিরে আসার সময় সাব আমাকে স্টেশনে এগিয়ে দিতে আসে। ট্রেন স্টেশনটিও একদম সুনসান আর নীরব। লোকজনের ভিড় নেই, নেই কোনো কোলাহল। একসময় আমার ট্রেন চলে আসে। পুরো ট্রেনই ফাঁকা, ফুখমি স্টেশনে তখন আমি আর একজন মহিলাযাত্রী ছাড়া আর কোনো যাত্রী নেই। ট্রেনের যে বগিতে আমি উঠেছি সেখানে আর কোনো যাত্রী নেই। মনে হচ্ছিল, ট্রেনটি আমি রিজার্ভ করে নিয়ে যাচ্ছি। রিজার্ভ ট্রেনটি বিশ মিনিট পর ট্রানজিট স্টেশন অনুয়ায় এমোখিতে পৌঁছে। সেখানে তেরো মিনিটের যাত্রাবিরতি শেষে আসে প্যারিসগামী ট্রেন। সেই ট্রেনেও যাত্রী বেশি নেই। আমি বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় ফ্রান্সের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে দেখতে একসময় প্যারিসে চলে আসি এবং ব্যস্ততম প্যারিসের অসংখ্য মানুষের ভিড়ে মিশে যাই।


























