০২:১২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

অনুবাদ সাহিত্যের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন

► ঘাটতি দূর করা দরকার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের
► অনুবাদের জন্য বাংলা একাডেমির একটি বড় পরিকল্পনা দরকার : মফিদুল হক
► হাঙর নদী গ্রেনেডের ইংরেজি অনুবাদ মানসম্মত নয় বলে স্বীকৃতি পায়নি : সেলিনা হোসেন

বিদেশি ভাষায় প্রকাশিত সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করে সাহিত্যপ্রেমী বাঙালিদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন দেশি অনুবাদকরা। আবার বাংলাদেশি কালজয়ী সাহিত্যগুলোকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বদরবারে তুলে ধরছেন দেশী অনুবাদকরা। এভাবে অনুবাদ সাহিত্যের হাত ধরে বাংলাভাষাভাষি লেখক-পাঠক বিশ^জনীন হয়ে উঠছেন। তবে, এখানেও অনেক বেশি ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। দরকার ভালো অনুবাদকদের অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী করে তোলা। আর এটি করতে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে বাংলা একাডেমি। এই একাডেমির অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে আলাদা একটি বিভাগ হতে পারে। যেখানে শুধু অনুবাদকরা কাজ করবেন। তারা সাহিত্যের অনুবাদে ভূমিকা রাখবেন। আবার বাংলা সাহিত্যকে বিশে^র দরবারে তুলে ধরতে ভূমিকা রাখবেন।

অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশে সাহিত্য প্রকাশের স্বত্ব¡াধিকারী ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, অনুবাদ সাহিত্যের বিস্তার অনেক ঘটেছে। বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ অনেক হচ্ছে। সামাজিক উদ্যোগে বেসরকারিভাবেই হচ্ছে। সেখানে মানের প্রশ্ন খুব চলে আসে। সেগুলো চালু বই, মানসম্পন্ন বই হচ্ছে কি না সেটা নিয়ে সংশয় আছে। ভিন্ন ভাষার বই বাংলায় অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দরকার। এটার জন্য বাংলা একাডেমি বা বাংলা উন্নয়ন বোর্ড আগে ছিল তারা অনেক কাজ করেছিল। উচ্চ শিক্ষার পর্যায়ে যে কাজগুলো করা দরকার, বিজ্ঞানের বই, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই, মূল পাঠ্যবই সেগুলো কিন্তু অনুবাদ হয়েছিল। সেই ধারাটা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটা এখন একেবারেই নাই। জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনুবাদের ব্যাপারে পরিকল্পিতভাবে কাজ করার দরকার আছে। আর যেগুলোর অনুবাদের চাহিদা আছে সেগুলো নানাভাবে অনুবাদ হয়ে যাবে। সেখানে অনুবাদের চর্চাটা খুব বাড়ানো দরকার এবং অনুবাদের বিচার বিশ্লেষণ, অনুবাদের আলোচনা এগুলো দরকার। তা না হলে বিচ্ছিন্নভাবে এগুলো হবে। অনুবাদের জন্য বাংলা একাডেমির একটি বড় পরিকল্পনা দরকার।
বাংলা একাডেমি সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় মোট তিন হাজার সাতশ ত্রিশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি ভাষা থেকে অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ৬৯টি। ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত মেলায় ৭৫টি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, অনুবাদ যত সমৃদ্ধ হতে তত সহজে তা বাংলা সাহিত্যকে বিশ^ দরবারে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে। এর জন্য বাংলা একাডেমির অনুবাদ শাখায় আর্থিক সহায়তা এবং প্রয়োজনীয় লোকবল বাড়ানো প্রয়োজন, পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনুবাদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যা ভালো অনুবাদ তৈরিতে যেমন ভূমিকা রাখবে তেমনি ভালো অনুবাদ করতেও উৎসাহিত করবে। অনেকেরই অভিযোগ, অনুবাদ সাহিত্যের বিপুল চাহিদা থাকলেও গুণগতমানের অনুবাদ হচ্ছে না। অনুবাদ সাহিত্যে মূল সাহিত্যের ভাবার্থ বদলে যাচ্ছে। এতে করে সাহিত্যের মূল্যমান ঠিক থাকছে না এমনটি অভিযোগ করেন গবেষকরা।
বাংলা একাডেমির প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা, মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, নীলিমা ইব্রাহিমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি, সৈয়দ শামসুল হকের সূর্য দীঘল বাড়িসহ বেশকিছু বইয়ের অন্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।

এছাড়া আল্লামা ইকবালের কাব্যসংগ্রহ অনুবাদ করেন অনুবাদক মনিরউদ্দীন ইউসুফ। বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপিয়ার এর লেখা, বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা, আল বেরুনীর ভারততত্ত্বসহ অনেক বই বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। চীনা, জাপানি, রুশ ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষার লেখকের বই অনুবাদ করেছে বাংলা একাডেমি। এই বইগুলোর তালিকায় সাহিত্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

তবে, অনুবাদ নিয়ে লেখকদের আক্ষেপও অনেক। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন তার আক্ষেপের কথা জানান। তিনি বলেন, তার হাঙ্গর নদী গ্রেনেড উপন্যাসটির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় সারাংশ পড়া হয়। এটি শুনে একজন মার্কিন প্রকাশক বইটির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলা উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ দেখে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন। ঐ প্রকাশক বলেন, এটি আসলে মার্কিন পাঠকদের উপযোগী নয়। এ প্রসঙ্গে সেলিনা হোসেন বলেন, দেশী সাহিত্যকে বিশ্ববাজারে পৌঁছে দিতে সরকারি পর্যায়ে একটি অনুবাদ সেল গঠন করতে হবে। এই সেলের বিশেষজ্ঞ প্যানেলটি ঠিক করে দেবে, আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের মান আসলে কেমন হওয়া উচিত এবং ঠিক কোন সাহিত্যগুলো বিশ্ববাজারে পৌঁছে দেওয়া হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

অনুবাদ সাহিত্যের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন

আপডেট সময় : ০৮:৫৮:৩২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১ মার্চ ২০২৪

► ঘাটতি দূর করা দরকার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের
► অনুবাদের জন্য বাংলা একাডেমির একটি বড় পরিকল্পনা দরকার : মফিদুল হক
► হাঙর নদী গ্রেনেডের ইংরেজি অনুবাদ মানসম্মত নয় বলে স্বীকৃতি পায়নি : সেলিনা হোসেন

বিদেশি ভাষায় প্রকাশিত সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ করে সাহিত্যপ্রেমী বাঙালিদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন দেশি অনুবাদকরা। আবার বাংলাদেশি কালজয়ী সাহিত্যগুলোকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বদরবারে তুলে ধরছেন দেশী অনুবাদকরা। এভাবে অনুবাদ সাহিত্যের হাত ধরে বাংলাভাষাভাষি লেখক-পাঠক বিশ^জনীন হয়ে উঠছেন। তবে, এখানেও অনেক বেশি ঘাটতি আছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। দরকার ভালো অনুবাদকদের অনুবাদ সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী করে তোলা। আর এটি করতে প্রধান ভূমিকা পালন করতে পারে বাংলা একাডেমি। এই একাডেমির অনুবাদ সাহিত্য নিয়ে আলাদা একটি বিভাগ হতে পারে। যেখানে শুধু অনুবাদকরা কাজ করবেন। তারা সাহিত্যের অনুবাদে ভূমিকা রাখবেন। আবার বাংলা সাহিত্যকে বিশে^র দরবারে তুলে ধরতে ভূমিকা রাখবেন।

অনুবাদ সাহিত্যের বিকাশে সাহিত্য প্রকাশের স্বত্ব¡াধিকারী ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, অনুবাদ সাহিত্যের বিস্তার অনেক ঘটেছে। বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ অনেক হচ্ছে। সামাজিক উদ্যোগে বেসরকারিভাবেই হচ্ছে। সেখানে মানের প্রশ্ন খুব চলে আসে। সেগুলো চালু বই, মানসম্পন্ন বই হচ্ছে কি না সেটা নিয়ে সংশয় আছে। ভিন্ন ভাষার বই বাংলায় অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দরকার। এটার জন্য বাংলা একাডেমি বা বাংলা উন্নয়ন বোর্ড আগে ছিল তারা অনেক কাজ করেছিল। উচ্চ শিক্ষার পর্যায়ে যে কাজগুলো করা দরকার, বিজ্ঞানের বই, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই, মূল পাঠ্যবই সেগুলো কিন্তু অনুবাদ হয়েছিল। সেই ধারাটা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটা এখন একেবারেই নাই। জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনুবাদের ব্যাপারে পরিকল্পিতভাবে কাজ করার দরকার আছে। আর যেগুলোর অনুবাদের চাহিদা আছে সেগুলো নানাভাবে অনুবাদ হয়ে যাবে। সেখানে অনুবাদের চর্চাটা খুব বাড়ানো দরকার এবং অনুবাদের বিচার বিশ্লেষণ, অনুবাদের আলোচনা এগুলো দরকার। তা না হলে বিচ্ছিন্নভাবে এগুলো হবে। অনুবাদের জন্য বাংলা একাডেমির একটি বড় পরিকল্পনা দরকার।
বাংলা একাডেমি সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় মোট তিন হাজার সাতশ ত্রিশটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশি ভাষা থেকে অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ৬৯টি। ২০২৪ সালে এ পর্যন্ত মেলায় ৭৫টি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, অনুবাদ যত সমৃদ্ধ হতে তত সহজে তা বাংলা সাহিত্যকে বিশ^ দরবারে পৌঁছে দিতে সক্ষম হবে। এর জন্য বাংলা একাডেমির অনুবাদ শাখায় আর্থিক সহায়তা এবং প্রয়োজনীয় লোকবল বাড়ানো প্রয়োজন, পাশাপাশি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অনুবাদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যা ভালো অনুবাদ তৈরিতে যেমন ভূমিকা রাখবে তেমনি ভালো অনুবাদ করতেও উৎসাহিত করবে। অনেকেরই অভিযোগ, অনুবাদ সাহিত্যের বিপুল চাহিদা থাকলেও গুণগতমানের অনুবাদ হচ্ছে না। অনুবাদ সাহিত্যে মূল সাহিত্যের ভাবার্থ বদলে যাচ্ছে। এতে করে সাহিত্যের মূল্যমান ঠিক থাকছে না এমনটি অভিযোগ করেন গবেষকরা।
বাংলা একাডেমির প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর কারাগারের রোজনামচা, মীর মোশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু, নীলিমা ইব্রাহিমের আমি বীরাঙ্গনা বলছি, সৈয়দ শামসুল হকের সূর্য দীঘল বাড়িসহ বেশকিছু বইয়ের অন্য ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে।

এছাড়া আল্লামা ইকবালের কাব্যসংগ্রহ অনুবাদ করেন অনুবাদক মনিরউদ্দীন ইউসুফ। বিখ্যাত ইংরেজ নাট্যকার শেক্সপিয়ার এর লেখা, বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা, আল বেরুনীর ভারততত্ত্বসহ অনেক বই বাংলায় অনুবাদ হয়েছে। চীনা, জাপানি, রুশ ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষার লেখকের বই অনুবাদ করেছে বাংলা একাডেমি। এই বইগুলোর তালিকায় সাহিত্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

তবে, অনুবাদ নিয়ে লেখকদের আক্ষেপও অনেক। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন তার আক্ষেপের কথা জানান। তিনি বলেন, তার হাঙ্গর নদী গ্রেনেড উপন্যাসটির ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় সারাংশ পড়া হয়। এটি শুনে একজন মার্কিন প্রকাশক বইটির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু পরবর্তীতে বাংলা উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ দেখে তিনি হতাশা প্রকাশ করেন। ঐ প্রকাশক বলেন, এটি আসলে মার্কিন পাঠকদের উপযোগী নয়। এ প্রসঙ্গে সেলিনা হোসেন বলেন, দেশী সাহিত্যকে বিশ্ববাজারে পৌঁছে দিতে সরকারি পর্যায়ে একটি অনুবাদ সেল গঠন করতে হবে। এই সেলের বিশেষজ্ঞ প্যানেলটি ঠিক করে দেবে, আমাদের অনুবাদ সাহিত্যের মান আসলে কেমন হওয়া উচিত এবং ঠিক কোন সাহিত্যগুলো বিশ্ববাজারে পৌঁছে দেওয়া হবে।