বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি দিন— বিষয়টি অনেকটা স্বপ্নের মতো। তবে হতাশার মধ্যেও আশার আলো উঁকি দেয়। যখন দর্শক সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়া শুরু করে, তখন দেশে হানা দেয় মহামারি। করোনার থাবায় স্থবির হয়ে যায় চলচ্চিত্র অঙ্গন। নেমে আসে অন্ধকার, শিল্পীরা ছাড়তে শুরু করে এই পেশা। ‘রাত যত গভীর হয় ভোর তত নিকটে আসে।’ প্রচলিত একটি বাক্য সত্য প্রমাণ হয় ‘হাওয়া’ ও ‘পরাণ’ সিনেমা মুক্তির পর।
বাংলা চলচ্চিত্রে আলো আসে। যে আলোয় পথ দেখে ‘প্রিয়তমা’সহ আরো কিছু সিনেমা মুক্তি পায়। বাংলা চলচ্চিত্রে বইতে শুরু করে সুবাতাস। বছরে দুয়েকটি সিনেমা সাড়া ফেললেও নিয়মিত না হওয়ায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারছে না। কারণ মাঝে মাঝে কিছু মানহীন সিনেমা বাতাস ভারি করে ফেলে। মানহীন কাজের জন্য এই অঙ্গনে হতাশার জন্ম দেয়। ভালো কাজ করলে সুদিন অবশ্যই আসবে এবং স্থায়ী হবে। অস্বীকার করা যাবে না— আশায় বুক বাঁধা অতি প্রতীক্ষিত কিছু সিনেমা মুক্তি পাওয়ায় দর্শক হলমুখী হচ্ছেন। ফলে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছে। তেমনি এবার ঈদে মুক্তি পাওয়া কয়েকটি সিনেমার মধ্যে ‘লিপস্টিক’ জাগানিয়া সিনেমা। ঈদে মুক্তি পাওয়া কামরুজ্জামান রোমানের ‘লিপস্টিক’ ছবিতে অভিনয় করেছেন আদর আজাদ ও পূজা চেরি। হল নিয়ে পলিটিকসের অভিযোগ অনেকের। এবার বেশির ভাগ সিনেমাই হলের সংখ্যা ১০ ছুঁতে পারেনি। হল না পেয়ে অনেক নির্মাতা-প্রযোজক অভিযোগও করছেন, তারা পলিটিকসের শিকার হয়েছেন। প্রত্যাশিত হল না পেয়ে ঈদের দুদিন আগে ‘লিপস্টিক’ সিনেমার নায়ক ও প্রযোজক আদর আজাদ এক ভিডিওতে দাবি করেন, আলোচনায় থাকলেও একটি চক্রের কারণে তার সিনেমাটি বেশি হল পায়নি।
ঈদের চার-পাঁচ দিন আগেও তিনি আরও যেসব হলের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন, সেই হলগুলোর মালিকরাও পিছিয়ে গেছেন। আদর জানান— লিপস্টিক সিনেমায় নিজের সব টাকা লগ্নি করেছেন। নিজের গাড়ি বিক্রি করেছেন, এমনকি মায়ের জমানো টাকাও খরচ করেছেন। হল না পাওয়ার কারণ হিসেবে অপরাজনীতিকে দুষেছেন এই নায়ক। ইতিবাচক খবর হচ্ছে— প্রথমে অল্পসংখ্যক হলে মুক্তি পেলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে বেশ কয়েকটি একক হলে প্রদর্শনী বেড়েছে ছবিটির। আগামী সপ্তাহে আরো হল বাড়বে। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সিনেমার প্রচারণার চিন্তারও পরিবর্তন হচ্ছে। সিনেমা দেখলেই মিলছে বিরিয়ানি। বগুড়ার ধুনট উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ঝংকার সিনেমা হলে প্রতিটি টিকিটের সঙ্গে দর্শকের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে এক প্যাকেট বিরিয়ানি। দর্শকদের হলমুখী করতে গত শনিবার থেকে এই বিশেষ অফার চালু করেছে হল কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি এলাকায় আলোচনার জন্ম দিয়েছে, দর্শক সমাগমও বাড়ছে, সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন আসছেন সংবাদকর্মী। এই সিনেমা নিয়ে দর্শকের আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। আশার আলো দেখছেন হল মালিক ও অভিনয়শিল্পীরা।
দর্শকের আগ্রহ-উন্মাদনা দেখে আদর আজাদ সব কষ্ট ভুলে গেছেন। তিনি বলেন— ‘যত রাজনীতি হোক না কেন ভালো কাজ দর্শক দেখবেন। আমি আনন্দিত। তিনি আরো বলেন— বগুড়ার ধুনটের ঝংকার সিনেমা হলের মালিক দর্শক হলমুখী করতে দর্শকের জন্য ফ্রি বিরিয়ানির ব্যবস্থা করেছেন। সিনেমা দেখলেই এই অফারটি পাচ্ছেন। হল মালিক ঈসা খানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
‘লিপস্টিক’ সিনেমা নিয়ে নায়িকা পূজা চেরীর মন খারাপ হলেও দর্শকের আগ্রহে মন ভালো হয়ে গেছে। তিনি বলেন— ‘প্রথম সপ্তাহে আমরা অল্পসংখ্যক হল পেয়েছিলাম। মনটা ভিষণ খারাপ ছিল কিন্তু দর্শকের আগ্রহ দেখে ভালো লাগছে। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে ময়মনসিংহের পূরবী, খুলনার সংগীতাসহ কয়েকটি জেলায় নতুন হল পেয়েছি। ‘লিপস্টিক’ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য নেই। দর্শক সিনেমাটির প্রশংসা করছেন। সিনেমাটি নিয়ে আমার আত্মবিশ্বাস ছিল। কাজটি ভালো হয়েছে। কনটেন্টে জোর আছে। এটি আমার অভিনয় জীরনের সেরা সিনেমা। আরেকটি বিষয় আমার কাছে খুবই অবাক লেগেছে। একজন হল মালিক প্রতিটি টিকিটের সঙ্গে দর্শকের হাতে তুলে দিচ্ছেন এক প্যাকেট বিরিয়ানি। আবার একদম ফ্রি, আমার জানা মতে এমন উদ্যোগ এর আগে কখনো কেউ নেননি। ঝংকার হলের মালিক একদম ভিন্নচিন্তার মানুষ। বিষয়টি কে কীভাবে নেবে জানি না, আমি ইতিবাচক হিসাবেই নিচ্ছি। শিগগিরই বগুড়ার ধুনটের এই সিনেমা হলে দর্শকের সঙ্গে বসে সিনেমাটি উপভোগ করব। ধুনটবাসীর সঙ্গে দেখা হবে আশা করছি।’
তরুণ দর্শক সামিয়া শবনম বলেন— ‘আমি আমার পরিবারে সঙ্গে সিনেমাটি দেখলাম। সিনেমাটি খুবই ভালো লেগেছে। সবাইকে সিনেমাটি দেখার অনুরোধ করছি। টিকিটের সঙ্গে বিরিয়ানি ফ্রি বিষয়টিও মুগ্ধ করেছে আমাকে। এই অভিনব উদ্যোগের জন্য দর্শক হলমুখী হবে। সিনেমা দেখার অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি, যা ঝংকার সিনেমার মালিক করছেন। আমার কাছে এক অভিনব প্রচারণা চিন্তা মনে হয়েছে। দর্শকদের হলমুখী করতে পরিচালক-প্রযোজকের সঙ্গে হল মালিকদেরও প্রচার করা জরুরি। ঝংকার সিনেমা হলের মালিক ইতিহাস গড়ল, তাকে ধন্যবাদ।’
বিনোদনের পাশাপাশি জীবন ও জগেক উপলব্ধি করতে শেখায় চলচ্চিত্র। একটি ভালো সিনেমা সমাজ সংস্কার, মানুষকে শিক্ষা দেয়া, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা এবং দেশকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখে। একটি ভালো সিনেমা দেখা এবং দেখার সুযোগ করে দেয়া সবারই কর্তব্য। ঝংকার সিনেমা হলের মালিক সেই কাজটি করছেন।
এ হলে ৫০০টি আসন রয়েছে। প্রতিটি টিকিটের মূল্য ১০০ টাকা। টিকিটের মূল্য অপরিবর্তিত রেখেই প্রত্যেক দর্শকের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে এক প্যাকেট বিরিয়ানি। এক মাস এই ফ্রি খাবারের ব্যবস্থা চালু থাকবে জানিয়েছে হল কর্তৃপক্ষ। হল মালিক ঈসা খান এ বিষয়ে বলেন— ‘বর্তমান প্রজন্ম টেলিভিশন ও মোবাইলের পর্দায় সিনেমা-নাটক দেখছেন। তাদের অনেকেই সিনেমা হল কী জানেন না। এমন কী তারা বড় পর্দায় যে সিনেমা দেখা যায় সেই ধারণাও নেই তাদের। আমার এই অফার এই প্রজন্মকে সিনেমা হলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া এবং দর্শকদের হলমুখী করার জন্য। আমি মনে করি এমন উদ্যোগ সব সিনেমা হল মালিকদের নেয়া উচিত এতে দর্শক হলমুখী হবে, সিনেমা দেখে অন্যদের সঙ্গে গল্প করবে, সিনেমা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা হবে। ফলে এক সময় দর্শক কোনো অফার ছাড়াই সিনেমা হলে এসে সিনেমা দেখবেন। এতে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকবে, শিল্পী বাঁচবে। আমরা হল মালিকরাও লাভবান হবো। দর্শকদের জন্য বলি, হলে আসুন, পরিবার নিয়ে সিনেমা দেখুন, বাংলা সংস্কৃতি রক্ষা করুন।’ সিনেমা হলে প্রতিদিন দুপুর ১২টা, বিকাল ৩টা, সন্ধ্যা ৬টা ও রাত ৯টায় ‘লিপস্টিক’ ছবি প্রদর্শন করা হচ্ছে।
কিন্তু প্রচণ্ড গরমের কারণে প্রতিদিন দুপুর ১২টা ও বিকাল ৩টায় দর্শকের উপস্থিতি কম থাকছে। তবে সন্ধ্যা ৬টা ও রাত ৯টায় হল ভর্তি দর্শক পাওয়া যাচ্ছে। হল কর্তৃপক্ষ বলছে, দর্শকদের আশানুরূপ সাড়া মিলেছে। ধুনটে ঝংকার সিনেমা হলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমরান হোসেন বলেন, ‘টিকিটের সঙ্গে বিরিয়ানি ফ্রি দেয়াতে আমরা ভালোই সাড়া পাচ্ছি। দর্শক টানতেই আমরা এ ব্যবস্থা নিয়েছি। আগের মতো ব্যবসা হচ্ছে না আমাদের, তবে আশা রাখছি, নির্মাতারা ভালো ছবি তৈরি করলে আবারও সিনেমা হলমুখী হবেন দর্শকরা।’ স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ধুনট শহরে ঈসা খানের মালিকানাধীন ঝংকার সিনেমা হলটি ১৯৮৪ সালে স্থাপিত হয়। দর্শক শূন্যতায় ২০১৪ সালে হলটিতে ছবি প্রদর্শন বন্ধ হয়। দীর্ঘ এক দশক পর গত ২০ এপ্রিল থেকে আবারও ঝংকারে ছবি প্রদর্শন শুরু করে হল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে হলে প্রদর্শিত হচ্ছে এবারের ঈদুল ফিতরে মুক্তি পাওয়া আদর আজাদ-পূজা চেরি অভিনীত সিনেমা ‘লিপস্টিক’। ‘লিপস্টিক’ সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন কামরুজ্জামান রোমান। সিনেমা নিয়ে দর্শকের মতামত বলে দেয় এ নির্মাতা মেধাবী। তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন এ সিনেমায়। মেধাবীর হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্রে আলো আসুক। আসতে শুরুও করেছে।
সিনেমা হল সংকটের মধ্যেও গত ঈদে বেশ কয়েকেটি সিনেমা মুক্তি দিয়েছেন নির্মাতারা। এর মধ্যে রাজকুমার, লিপস্টিক, ওমর, দেয়ালের দেশ এবং কাজলরেখা নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হচ্ছে। এই সুবাতাস বলে দেয় আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাংলা চলচ্চিত্র। দর্শক হলমুখী হচ্ছেন— এটি অবশ্য ইতিবাচক। এমন পরিবেশ টিকে রাখতে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের চিন্তা প্রসারিত করতে হবে। শুধু সিনেমা নির্মাণ করলেই হবে না— সময়, দর্শকের চিন্তাকে স্পর্শ করছে কিনা বুঝতে হবে। ফিরে আসুক বাংলা সিনেমার সোনালি দিন। জয় হোক শিল্পের, জয় হোক বাংলা সংস্কৃতির।


























