১১:৪৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সাংবাদিকদেরও একটা রাজনীতি আছে : মাহমুদা চৌধুরী

স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যেসব নারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মাহমুদা চৌধুরী। তিনি চল্লিশ বছর ধরে এই পেশায় থেকে পেশাকে সমৃদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে পেরিয়েছেন নানা চড়াই-উৎরাই। তিনি একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন, তার জীবনের না বলা অনেক কথা। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন দৈনিক সবুজ বাংলা’র রিপোর্টার তাসকিনা ইয়াসমিন। আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে তার সাক্ষাতকার ছাপা হচ্ছে। 
পর্ব – ৩

দিল মনোয়ারা মনুর হাত ধরে প্রথম বেগম পত্রিকায় লেখার সুযোগ পাই, সাদরে গ্রহণ করেন সম্পাদক নুরজাহান বেগম।

এদিকে, দিল মনোয়ারা মনু, তখন উনি বেগমে কাজ  করতেন। বেগমে তো তেমন কোন পোস্ট ছিল না। উনি সম্ভবত সহকারি সম্পাদিকা এমন পরিচয়ে ছিলেন। উনি আমাদের পাড়ার মেয়ে। আমরা একসঙ্গেই বড় হয়েছি। উনি আমাকে একদিন বললেন যে, আপনার লেখার হাতটা ভাল। বেগমে লিখলেই তো হয়। আমি তো বললাম, এখন পর্যন্ত তো এমনি লিখছি। ভাল লাগেনা। কি লিখব? লেখার কি  আছে? আসলে চাপ না থাকলে যা হয় আর কি!
তখন আমি নিজেকে ব্যস্ত রাখি। ফুলের বাগান করি। জামাই সামলাই। বাচ্চাদের সামলাই। আমি সিরিয়াসলি সাংবাদিকতা নিয়ে ভাবিনি। একদিন বেগম থেকে নুরজাহান বেগম আপা আমাকে ফোন করলেন। নিশ্চয় দিল মনোয়ারা মনুই বলেছেন। আমার নাম্বার দিয়েছেন। হয়ত আপাকে বলেছে, আমি তো বলেছি ও লিখছে না। আপনি যদি ফোন করেন হয়ত ও লিখবে।
সম্পাদিকা নুরজাহান বেগম আমাকে ফোন করেছে? আমার গা শিরশির করছে। হাত কাঁপছে আমার। আনন্দে, আবেগে। আমার হাত কাঁপছিল। উনি আমাকে বললেন, দেখ আমি মনুর কাছে তোমার অনেক গল্প শুনেছি। তুমি সামনে ৩০শে জানুয়ারিতে জহির রায়হানের নিখোঁজ দিবস উপলক্ষে আমাকে একটা লেখা দাও। আমি আর না করতে পারলাম না। আমি বললাম, দিব আপা। তখন আপা বললেন, আমার অফিসের নাম্বার জানো? আমি বললাম জ্বী, জানি আপা। সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুত মাথাতে আমার যা ছিল তাই লিখে ফেললাম। তখন আমার  ব্রেনটা এত কম্পিউটারের মতো ছিল যে, সবই তখন মাথায় থাকত।
আমি তাড়াতাড়ি করে উনার লেখাটা কমপ্লিট করলাম। এরপর তাকে আমি পাঠিয়ে দিলাম। আমাদের বাসায় মহুরি ছিল যে, তাকে আমি কিছু দিয়ে বললাম যে, আপনি একটু যান। বেগম অফিসে গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসেন। উনি গিয়ে পৌঁছে দিলেন। পরে বেগমে লেখাটা ছাপা হলো। তখন আমিও বেগম রাখতাম। এই যে বেগমে আমার লেখাটা ছাপা হলো। তখন আমার কাছে ভারি অবাক লাগল, মনে হলো যে, ‘আমার লেখা বেগমে ছাপা হয়েছে।’ তারপর আপা আমাকে ফোন দিল এবং বলল, আমাদের একজন একটু অসুস্থ ও পারে না লিখতে। তুমি এই কাজটা নাও। আমি বললাম ঠিক আছে আপা? আপা, আমি কি পারব! আপা বললেন, নিশ্চয় পারবে তুমি। তুমি শুরু করো পারবে। তুমি প্রতি সপ্তাহে আমাকে একটা করে লেখা দেবে। আমি একটা করে লেখা পাঠাতাম। পরে, ছাপা হতো! দিল মনোয়ারা মনু আপার অবদান আছে আমার সাংবাদিকতায় আসার পেছনে। নুরজাহান আপারও অবদান আছে। উনি আমাকে গাইড দিলেন। আমি তো তখন মাসিক বেতনে চাকরি করি, একদিন আনতে গেলাম। তখন আমাকে একদিন উনি বললেন, তুমি কি ইন্টারভিউ নিতে পারবে! এই আমাকে উনি মূল সাংবাদিকতায় নিয়ে আসলেন।
তখন আমি আপাকে বললাম, আপা আমি তো কখনও করি নাই আপনি বলে দিলে আমি করতে পারব।
তখন উনি আমাকে বললেন, তুমি কবি মঈনুদ্দীনের কবিতা পড়েছ? আমি বললাম জ্বী পড়েছি। তারপর উনি ব্যাকগ্রাউন্ডটা বললেন। উনি চমৎকার একজন মেকার। একজন ভাল সাংবাদিক হওয়ার জন্য সত্যিকারের একজন মেকার লাগে। কি করতে হবে? তার ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেয়া। কবি মঈনুদ্দীন এবং তার স্ত্রী, তখন নাকি একটা আন্দোলন হয়েছিল কলকাতায়। বোরখা হটাও। সেই আন্দোলনে বাঙালি মেয়েরা পর্দা খুলে সাধারণভাবে রাস্তা দিয়ে চলল। এই কাজে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের মধ্যে কবি মঈনুদ্দীনের বউ ছিল। মোল্লারা তখন কী কঠিন! এখনকার চেয়ে তারা কম ছিলনা। সেই সময় নাসিরুদ্দীনের অনুপ্রেরণায় এই মেয়েরা, কবি-সাহিত্যিকের মেয়ে, বউরা, আরো আলোকিত নারীরা তারা মাথার বোরখা খুলে রাস্তায় হেঁটেছিল। এদের মধ্যে কবি মঈনুদ্দীনের স্ত্রী ছিল।
রুপচাঁদ লেনে উনাদের বাসা ছিল। তখন আমি খুব গলি ঘুরি নাই। ঘোরার সুযোগ হয়নি। আমি অনেককে জিজ্ঞেস করে করে সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি বাসার দরজাটা খুলে দিল সে আমার বান্ধবী মিনু! আমি তো দেখে অবাক! মিনু! তুমি! ও  আমাকে জড়ায় ধরল। বলল, আরে তুই তুই কতদিন পরে দেখা হলো! তুই  যে আসবি এটা তো জানিনা। আমাকে বেগম অফিস থেকে বলল যে এক সাংবাদিক পাঠাচ্ছি ইন্টারভিউ করার জন্য (ওটা কিন্তু আমার জীবনের প্রথম সাংবাদিকতা!) আমি তাকে পাঠাচ্ছি। তোমরা একটু কো-অপারেশন করো। আমি তখন বুকে একটা বল পেলাম। বাবা! আমার পাশে একজন মানুষ আছে। সেই সময় কবি এবং তার স্ত্রী তারা দুজনেই প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। গিয়ে দেখি, তারা দুজনে পাশাপাশি দুটো বিছানায় শুয়ে আছে। আর কবির কথা তো স্পষ্ট বোঝা যায়না।
আমি তাকে প্রশ্ন করছি। উনি উত্তর দিচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি না। বুঝতে না পারার কারণে উনি রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে মেয়েকে বলছেন, ফোনটা দে তো! নুরজাহান কাকে পাঠিয়েছে? আমার কথাই বোঝেনা। সে কিন্তু খুব কথা জড়িয়ে বলছে। তখন মিনু বলল বাবা বাবা, ও  আমার বন্ধু। ওকে তো ওভাবে বললে হবে না। ও তো নতুন এসেছে। ও  নতুন সাংবাদিক। ওকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। আপনি তো জানেন ও  নতুন! তখন উনি বললেন, ও তোর বান্ধবী! ও  আচ্ছা আচ্ছা। তখন সে একটু শান্ত হলো! খুব ধীরে ধীরে ইন্টারভিউ দিল। এরপর আমি ফিরে এসে লিখে আপাকে দিলাম। আমি ভাবছি ছাপা-টাপা হবে না বোধহয়।
পরে দেখলাম যে এটা ছাপা হয়ে গেছে। পরে এমন সব লোকদের ইন্টারভিউ করেছি আমি সেই সময়। আপা আমাকে পাঠিয়েছেন। তারা মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। একদম শেষ মুহুর্তে। লায়লা সামাদেরটা তো আরও স্মরণীয়! লায়লা সামাদের ইন্টারভিউ করতে গিয়েছি। এত সুন্দর একজন মহিলা ছিলেন উনি কল্পনা করা যায়না। মগবাজারে থাকতেন। আমি থাকি পুরান ঢাকায়। মগবাজারে গলির ভিতরে এসেছিলাম তার ইন্টারভিউ করার জন্য। এখনকার আদ্ব-দীনের গলির ভিতরে উনার বাসা ছিল। খুব সুন্দর সাজানো গোছানো। একেবারে রাজকীয় সবকিছু। প্রথমবার উনার সঙ্গে দেখা হলো।
দেখা হওয়ার পরে আমি তো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু আমি নিজেও জানতাম না যে উনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম বাঙালি নারী যিনি নাকি জার্নালিজমে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এবং গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। উনাকে নিয়ে আসলে আমাদের গবেষণা করা উচিত। উনি কিন্তু ওখান থেকে এসে আমাদের বাংলাদেশে পূর্বদেশে কাজ করেছেন। অবজারভারে কাজ করেছেন এবং সেগুলো কিন্তু ফুলটাইম পেশাজীবী ছিল। ফুলটাইম করেছেন। ডেস্কে কাজ করেছেন কিন্তু আমাদের মতো রিপোর্টিং করেননি। কিন্তু তাকে আমরা সবাই ভুলে গেছি। তার নামটা কেউ বলে না। এটা সত্যি খুব দু:খজনক। আপা আমাকে উনার ব্যাকগ্রাউন্ডটা বলে আমাকে পাঠালেন। তখন আমার উনার ব্যাপারে খুব জ্ঞান ছিল তা না। তবে, নিজেকে আমার খুব ধন্য মনে হয়। সনজীদা আপার ইন্টারভিউ করেছিলাম। তখন অনেকের ইন্টারভিউ করেছিলাম। এখন অনেকের নামও ভুলে গেছি।
বেগমে যে প্রশ্নোত্তরের পাতা ছিল মহুয়া। সেখানে আমি উত্তর দিতাম! খুব মজা লাগত। ওখানকার মধ্যে অনেক ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত লেখক। কবি-লেখক তারা। শাহজাদী বলে একটা মেয়ে প্রত্যেক সপ্তাহে আটটা নয়টা চিঠি পাঠাত। এত গাদা গাদা চিঠি খুলে খুলে পড়ে তার মধ্যে বাছাই করে উত্তর দিতে হতো! অনেক পরিশ্রমের কাজ ছিল। তারপরে লিয়াকত হোসেন খোকন, সাংবাদিক ছিল। ও লিখত। সেই সময় তরুণরা সবাই মহুয়াতে লিখত। আমি তখন তাদের উত্তর দিতাম।
‘বেগম’ এ আমি মহুয়া দি হয়ে কত মজার চিঠির উত্তর দিয়েছি।
একদিন খুব মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। লিয়াকত হোসেন খোকনের মা মারা গেছে। উনি চিঠি পাঠিয়েছেন, উত্তর দা, আমার মা মারা গিয়েছেন। আমার খুব মন খারাপ। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন। আর  ঐ একই চিঠি সে আমাকে পাঠিয়েছে। মহুয়া দি, আমার মা মারা গিয়েছেন। আমার খুব মন খারাপ। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।
উত্তর দা ছিল এ কে এম আব্দুল হাই। খোকন দুইজনের কাছে উল্টা-পাল্টা চিঠি পাঠিয়েছে। আমি তো উত্তর দিয়েছি নর্মালি। কিন্তু উত্তর দা উত্তর দিয়েছে ‘তুমি ভুল করে রং নাম্বারে চিঠিটা পাঠিয়েছ।’
তখন আমিও উত্তরদার চিঠিটা পড়তাম। ভাল লাগত পড়তে। তো, তখন এইভাবেই শুরু হয়েছিল।
আগামীকাল প্র্রকাশিত হবে চতুর্থ পর্ব। 
জনপ্রিয় সংবাদ

নায়ক রিয়াজের মৃত্যুসংবাদ ফেসবুকে, যা জানাল পরিবার

সাংবাদিকদেরও একটা রাজনীতি আছে : মাহমুদা চৌধুরী

আপডেট সময় : ০৫:১৩:৪৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪
স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যেসব নারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মাহমুদা চৌধুরী। তিনি চল্লিশ বছর ধরে এই পেশায় থেকে পেশাকে সমৃদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে পেরিয়েছেন নানা চড়াই-উৎরাই। তিনি একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন, তার জীবনের না বলা অনেক কথা। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন দৈনিক সবুজ বাংলা’র রিপোর্টার তাসকিনা ইয়াসমিন। আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে তার সাক্ষাতকার ছাপা হচ্ছে। 
পর্ব – ৩

দিল মনোয়ারা মনুর হাত ধরে প্রথম বেগম পত্রিকায় লেখার সুযোগ পাই, সাদরে গ্রহণ করেন সম্পাদক নুরজাহান বেগম।

এদিকে, দিল মনোয়ারা মনু, তখন উনি বেগমে কাজ  করতেন। বেগমে তো তেমন কোন পোস্ট ছিল না। উনি সম্ভবত সহকারি সম্পাদিকা এমন পরিচয়ে ছিলেন। উনি আমাদের পাড়ার মেয়ে। আমরা একসঙ্গেই বড় হয়েছি। উনি আমাকে একদিন বললেন যে, আপনার লেখার হাতটা ভাল। বেগমে লিখলেই তো হয়। আমি তো বললাম, এখন পর্যন্ত তো এমনি লিখছি। ভাল লাগেনা। কি লিখব? লেখার কি  আছে? আসলে চাপ না থাকলে যা হয় আর কি!
তখন আমি নিজেকে ব্যস্ত রাখি। ফুলের বাগান করি। জামাই সামলাই। বাচ্চাদের সামলাই। আমি সিরিয়াসলি সাংবাদিকতা নিয়ে ভাবিনি। একদিন বেগম থেকে নুরজাহান বেগম আপা আমাকে ফোন করলেন। নিশ্চয় দিল মনোয়ারা মনুই বলেছেন। আমার নাম্বার দিয়েছেন। হয়ত আপাকে বলেছে, আমি তো বলেছি ও লিখছে না। আপনি যদি ফোন করেন হয়ত ও লিখবে।
সম্পাদিকা নুরজাহান বেগম আমাকে ফোন করেছে? আমার গা শিরশির করছে। হাত কাঁপছে আমার। আনন্দে, আবেগে। আমার হাত কাঁপছিল। উনি আমাকে বললেন, দেখ আমি মনুর কাছে তোমার অনেক গল্প শুনেছি। তুমি সামনে ৩০শে জানুয়ারিতে জহির রায়হানের নিখোঁজ দিবস উপলক্ষে আমাকে একটা লেখা দাও। আমি আর না করতে পারলাম না। আমি বললাম, দিব আপা। তখন আপা বললেন, আমার অফিসের নাম্বার জানো? আমি বললাম জ্বী, জানি আপা। সঙ্গে সঙ্গে খুব দ্রুত মাথাতে আমার যা ছিল তাই লিখে ফেললাম। তখন আমার  ব্রেনটা এত কম্পিউটারের মতো ছিল যে, সবই তখন মাথায় থাকত।
আমি তাড়াতাড়ি করে উনার লেখাটা কমপ্লিট করলাম। এরপর তাকে আমি পাঠিয়ে দিলাম। আমাদের বাসায় মহুরি ছিল যে, তাকে আমি কিছু দিয়ে বললাম যে, আপনি একটু যান। বেগম অফিসে গিয়ে টাকাটা দিয়ে আসেন। উনি গিয়ে পৌঁছে দিলেন। পরে বেগমে লেখাটা ছাপা হলো। তখন আমিও বেগম রাখতাম। এই যে বেগমে আমার লেখাটা ছাপা হলো। তখন আমার কাছে ভারি অবাক লাগল, মনে হলো যে, ‘আমার লেখা বেগমে ছাপা হয়েছে।’ তারপর আপা আমাকে ফোন দিল এবং বলল, আমাদের একজন একটু অসুস্থ ও পারে না লিখতে। তুমি এই কাজটা নাও। আমি বললাম ঠিক আছে আপা? আপা, আমি কি পারব! আপা বললেন, নিশ্চয় পারবে তুমি। তুমি শুরু করো পারবে। তুমি প্রতি সপ্তাহে আমাকে একটা করে লেখা দেবে। আমি একটা করে লেখা পাঠাতাম। পরে, ছাপা হতো! দিল মনোয়ারা মনু আপার অবদান আছে আমার সাংবাদিকতায় আসার পেছনে। নুরজাহান আপারও অবদান আছে। উনি আমাকে গাইড দিলেন। আমি তো তখন মাসিক বেতনে চাকরি করি, একদিন আনতে গেলাম। তখন আমাকে একদিন উনি বললেন, তুমি কি ইন্টারভিউ নিতে পারবে! এই আমাকে উনি মূল সাংবাদিকতায় নিয়ে আসলেন।
তখন আমি আপাকে বললাম, আপা আমি তো কখনও করি নাই আপনি বলে দিলে আমি করতে পারব।
তখন উনি আমাকে বললেন, তুমি কবি মঈনুদ্দীনের কবিতা পড়েছ? আমি বললাম জ্বী পড়েছি। তারপর উনি ব্যাকগ্রাউন্ডটা বললেন। উনি চমৎকার একজন মেকার। একজন ভাল সাংবাদিক হওয়ার জন্য সত্যিকারের একজন মেকার লাগে। কি করতে হবে? তার ব্যাকগ্রাউন্ডটা দেয়া। কবি মঈনুদ্দীন এবং তার স্ত্রী, তখন নাকি একটা আন্দোলন হয়েছিল কলকাতায়। বোরখা হটাও। সেই আন্দোলনে বাঙালি মেয়েরা পর্দা খুলে সাধারণভাবে রাস্তা দিয়ে চলল। এই কাজে যারা অংশ নিয়েছিল তাদের মধ্যে কবি মঈনুদ্দীনের বউ ছিল। মোল্লারা তখন কী কঠিন! এখনকার চেয়ে তারা কম ছিলনা। সেই সময় নাসিরুদ্দীনের অনুপ্রেরণায় এই মেয়েরা, কবি-সাহিত্যিকের মেয়ে, বউরা, আরো আলোকিত নারীরা তারা মাথার বোরখা খুলে রাস্তায় হেঁটেছিল। এদের মধ্যে কবি মঈনুদ্দীনের স্ত্রী ছিল।
রুপচাঁদ লেনে উনাদের বাসা ছিল। তখন আমি খুব গলি ঘুরি নাই। ঘোরার সুযোগ হয়নি। আমি অনেককে জিজ্ঞেস করে করে সেখানে গেলাম। গিয়ে দেখি বাসার দরজাটা খুলে দিল সে আমার বান্ধবী মিনু! আমি তো দেখে অবাক! মিনু! তুমি! ও  আমাকে জড়ায় ধরল। বলল, আরে তুই তুই কতদিন পরে দেখা হলো! তুই  যে আসবি এটা তো জানিনা। আমাকে বেগম অফিস থেকে বলল যে এক সাংবাদিক পাঠাচ্ছি ইন্টারভিউ করার জন্য (ওটা কিন্তু আমার জীবনের প্রথম সাংবাদিকতা!) আমি তাকে পাঠাচ্ছি। তোমরা একটু কো-অপারেশন করো। আমি তখন বুকে একটা বল পেলাম। বাবা! আমার পাশে একজন মানুষ আছে। সেই সময় কবি এবং তার স্ত্রী তারা দুজনেই প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। গিয়ে দেখি, তারা দুজনে পাশাপাশি দুটো বিছানায় শুয়ে আছে। আর কবির কথা তো স্পষ্ট বোঝা যায়না।
আমি তাকে প্রশ্ন করছি। উনি উত্তর দিচ্ছেন, আমি বুঝতে পারছি না। বুঝতে না পারার কারণে উনি রেগে গেলেন। রেগে গিয়ে মেয়েকে বলছেন, ফোনটা দে তো! নুরজাহান কাকে পাঠিয়েছে? আমার কথাই বোঝেনা। সে কিন্তু খুব কথা জড়িয়ে বলছে। তখন মিনু বলল বাবা বাবা, ও  আমার বন্ধু। ওকে তো ওভাবে বললে হবে না। ও তো নতুন এসেছে। ও  নতুন সাংবাদিক। ওকে আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। আপনি তো জানেন ও  নতুন! তখন উনি বললেন, ও তোর বান্ধবী! ও  আচ্ছা আচ্ছা। তখন সে একটু শান্ত হলো! খুব ধীরে ধীরে ইন্টারভিউ দিল। এরপর আমি ফিরে এসে লিখে আপাকে দিলাম। আমি ভাবছি ছাপা-টাপা হবে না বোধহয়।
পরে দেখলাম যে এটা ছাপা হয়ে গেছে। পরে এমন সব লোকদের ইন্টারভিউ করেছি আমি সেই সময়। আপা আমাকে পাঠিয়েছেন। তারা মৃত্যুর অপেক্ষা করছে। একদম শেষ মুহুর্তে। লায়লা সামাদেরটা তো আরও স্মরণীয়! লায়লা সামাদের ইন্টারভিউ করতে গিয়েছি। এত সুন্দর একজন মহিলা ছিলেন উনি কল্পনা করা যায়না। মগবাজারে থাকতেন। আমি থাকি পুরান ঢাকায়। মগবাজারে গলির ভিতরে এসেছিলাম তার ইন্টারভিউ করার জন্য। এখনকার আদ্ব-দীনের গলির ভিতরে উনার বাসা ছিল। খুব সুন্দর সাজানো গোছানো। একেবারে রাজকীয় সবকিছু। প্রথমবার উনার সঙ্গে দেখা হলো।
দেখা হওয়ার পরে আমি তো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কিন্তু আমি নিজেও জানতাম না যে উনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে প্রথম বাঙালি নারী যিনি নাকি জার্নালিজমে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এবং গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন। উনাকে নিয়ে আসলে আমাদের গবেষণা করা উচিত। উনি কিন্তু ওখান থেকে এসে আমাদের বাংলাদেশে পূর্বদেশে কাজ করেছেন। অবজারভারে কাজ করেছেন এবং সেগুলো কিন্তু ফুলটাইম পেশাজীবী ছিল। ফুলটাইম করেছেন। ডেস্কে কাজ করেছেন কিন্তু আমাদের মতো রিপোর্টিং করেননি। কিন্তু তাকে আমরা সবাই ভুলে গেছি। তার নামটা কেউ বলে না। এটা সত্যি খুব দু:খজনক। আপা আমাকে উনার ব্যাকগ্রাউন্ডটা বলে আমাকে পাঠালেন। তখন আমার উনার ব্যাপারে খুব জ্ঞান ছিল তা না। তবে, নিজেকে আমার খুব ধন্য মনে হয়। সনজীদা আপার ইন্টারভিউ করেছিলাম। তখন অনেকের ইন্টারভিউ করেছিলাম। এখন অনেকের নামও ভুলে গেছি।
বেগমে যে প্রশ্নোত্তরের পাতা ছিল মহুয়া। সেখানে আমি উত্তর দিতাম! খুব মজা লাগত। ওখানকার মধ্যে অনেক ছেলেমেয়েরা প্রতিষ্ঠিত লেখক। কবি-লেখক তারা। শাহজাদী বলে একটা মেয়ে প্রত্যেক সপ্তাহে আটটা নয়টা চিঠি পাঠাত। এত গাদা গাদা চিঠি খুলে খুলে পড়ে তার মধ্যে বাছাই করে উত্তর দিতে হতো! অনেক পরিশ্রমের কাজ ছিল। তারপরে লিয়াকত হোসেন খোকন, সাংবাদিক ছিল। ও লিখত। সেই সময় তরুণরা সবাই মহুয়াতে লিখত। আমি তখন তাদের উত্তর দিতাম।
‘বেগম’ এ আমি মহুয়া দি হয়ে কত মজার চিঠির উত্তর দিয়েছি।
একদিন খুব মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। লিয়াকত হোসেন খোকনের মা মারা গেছে। উনি চিঠি পাঠিয়েছেন, উত্তর দা, আমার মা মারা গিয়েছেন। আমার খুব মন খারাপ। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন। আর  ঐ একই চিঠি সে আমাকে পাঠিয়েছে। মহুয়া দি, আমার মা মারা গিয়েছেন। আমার খুব মন খারাপ। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।
উত্তর দা ছিল এ কে এম আব্দুল হাই। খোকন দুইজনের কাছে উল্টা-পাল্টা চিঠি পাঠিয়েছে। আমি তো উত্তর দিয়েছি নর্মালি। কিন্তু উত্তর দা উত্তর দিয়েছে ‘তুমি ভুল করে রং নাম্বারে চিঠিটা পাঠিয়েছ।’
তখন আমিও উত্তরদার চিঠিটা পড়তাম। ভাল লাগত পড়তে। তো, তখন এইভাবেই শুরু হয়েছিল।
আগামীকাল প্র্রকাশিত হবে চতুর্থ পর্ব।