পর্ব – ২
মেজ ভাইয়ের সুবাদেই রাজনীতির অঙ্গনে প্রথম অংশগ্রহণের সুযোগ পাই:-
৬২’র শিক্ষা আন্দোলন আমি তখন ফাইভে বা সিক্সে পড়ি। তখন একদিন নেত্রকোনায় সব স্কুলে স্ট্রাইক এবং মিছিলের পরিকল্পনা ছিল। শুধু আমরা জানি, তখন ক্লাস নাইনের নেতৃস্থানীয় আপারা এসে বলল যে, অন্যান্য স্কুল কলেজের ছেলেরা গেটে আসলেই আমরা সবাই ক্লাস থেকে বের হয়ে মিছিলে যোগদান করব। তখন, আমাদের প্রশ্ন ছিল যে, ক্লাসে তো টিচার থাকবেন। তো, টিচার যদি পারমিশন না দেন তাহলে আমরা কেমন করে যাব। তখন তো টয়লেটে যেতে অনুমতি নিয়ে যেতে হতো। উনি যদি অনুমতি না দেন। বলল যে, উনার অনুমতি চাইতেই হবে না। আমরা সবাই একসাথে বের হবো। যাই হোক, যখন মূল গেটে ছেলেদের শ্লোগান শুনতে লাগলাম, আমাদের স্কুলের ঠিক উল্টো দিকেই দত্ত হাই স্কুল ছিল। দত্ত স্কুল, চন্দ্রনাথ হাইস্কুল, আঞ্জুমান হাইস্কুল এগুলো থেকে এসেছে। সুতরাং আমরা খুব মজা পেলাম। স্যার কে রেখেই আমরা ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলাম। মিছিলে স্বাভাবিকভাবেই সব যায়গায় মেয়েদেরকে সামনে দেয়া হয়। আমাদেরকেও সামনে দেয়া হলো। সামনে একটা পতাকা দিবে। সামনের মেয়েরা কেউ ধরতে চাচ্ছেনা। এরমধ্যে কে একজন বলল যে, মর্তুজা ভাইয়ের বোন এইখানে আছে। ওর হাতে দাও। আমি নিলাম। আমি কিন্তু কিছুই জানিনা যে, কি বিষয় নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। তারপরেও নিলাম। তারপরে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরলাম। যদি বাবা জানে এই অবস্থা কি হবে! হয় উনি এই ইনফরমেশনটা জেনেও কিছু বলেন নাই অথবা উনি এই ইনফরমেশনটা এভাবে জানেননা। দুইটার একটা হবে কারণ আমি কখনও এটা আর চেক করতে যাইনি।
আমার আরেক ভাই, লুৎফর রহমান। উনি পরবর্তীতে ট্রেড ইউনিয়নের নেতা হন। উনি তখন কলেজে পড়তেন! সুতরাং লুৎফর রহমান ভাই এবং তাদের সঙ্গে অন্যান্যরা এই আন্দোলনটা বেগবান করেছিলেন। তখন আমি জানতাম না যে এটা ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন না কি অন্য কিছু কিন্তু অংশগ্রহণ করেছিলাম।
এখন আমাদের নারী আন্দোলনকে বলে যে তোমরা পশ্চিমা শিক্ষিত ! আমাদের মায়েরা কি পশ্চিমা শিক্ষিত ছিলেন?
আমার মায়েরা তো পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক হিউম্যান এটিটিউট সম্পর্কে শিখেছি। আমার মা নামাজ পড়তেন। তিনি কয়েকটা গল্প বলতেন। সেগুলো এখন আমার মনে আছে। একটা গল্প – ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে এই সম্পর্কে।
তখন তো মসজিদে একটা বাক্স থাকত। সেখানে সবাই চাঁদা দিত। সেখান থেকে প্রায় প্রায়ই টাকা চুরি হয়ে যেত। মসজিদের কমিটি তারা সিদ্ধান্ত নিল যে একজন পাহারাদার রাখবে। পাহারাদার লাঠি নিয়ে অপেক্ষা করল। তখন চোর আসল। রাত্রি বেলা। তখন তো আর ইলেকট্রিসিটি ছিলনা। চোর এসে বাক্সটা খোলার আগে বলতে থাকল, হে আল্লাহ মাবুদ তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছো। তুমি আমার চিন্তা দিয়েছ, তুমি আমার দুইটা হাত দিয়েছো। আজকে যে আমি এই টাকাগুলা এখান থেকে নিচ্ছি এটাও কিন্তু তোমার হুকুমে আমি নিচ্ছি। এই কথা বলে সে পয়সা নেয়া শুরু করল।
তখন যে পাহারাদার ছিল লাঠি নিয়ে সেও এগিয়ে আসল। সে এসে বলল, হে আল্লাহ তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ। তুমি হাত দুইটা দিয়েছ। আমার হাতে যে লাঠিটা এটাও তোমার। আমি যে এখন মাথায় বাড়ি দিয়ে এই চোরটাকে মারছি, এটাও তোমার হুকুম। তো এই গল্পের মধ্য দিয়ে আমার মা কিন্তু ধর্মের অপব্যবহার কিভাবে হয় এই গল্প কিন্তু সেই ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন।
আর একটা গল্প মা করেছিলেন আমার মনে আছে। আমরা মানুষ হিসেবে কাকে দেখি?
গ্রামের পুকুরে মহিলারা যায় গোসল করতে। কাজ শেষ করে তিনটা সাড়ে তিনটার দিকে তারা পুকুরে গোসল করতে যেত। ঐ পুকুরের পাশ দিয়ে মানুষজন হাটে যেত। তো গ্রামের মহিলারা একটা ছেলে পুকুরের পাশে রেখেছে যে, কোন মানুষ আসলে সাড়া দিবি যে, মানুষ আসছে। তখন মহিলারা আড়ালে চলে যাবে। একটু পরে ঐ ছেলে বলছে যে মানুষ আইতাছে মানুষ আইতাছে। যেই বলেছে। তখন সবাই ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে গিয়ে লুকিয়েছে। তারপরে দেখা গেল ঘোড়ার পিঠে পাট নিয়ে বা ধান নিয়ে এক লোক বাজারে যাচ্ছে। বিক্রি করার জন্য। সে চলে গেলে ছেলেটা বলল, এখন পুকুরে নামতে পার আর মানুষ নাই। তখন ঐ মহিলারা বলল, এই হারামজাদা তোরে বলছি মানুষ আসলে বলবি। এটা তো ঘোড়াওয়ালা। অর্থাৎ সে মানুষ না। হাহাহা।
তখন কিন্তু আমরা ছোটবেলায় দেখেছি পর্দা করার বিষয়টা। ভদ্রলোক দেখলে একটু আড়ালে চলে যেত। কিন্তু যারা কৃষি কাজ করছে। তাদেরকে মানুষ বলে গন্য করা হতো এবং তাদের সামনে যাওয়ার জন্য পর্দা করতে হতো না। এই যে, মানুষ বলে গণ্য করা না করা এই শিক্ষাটা কিন্তু আমার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া।
মা একটা কথা বলতেন, রাজা চিন্তায় মরে তার রাজ্য নিয়ে যে অনেক বড় দায়িত্ব পালন করতে হয় কিন্তু যোগী চিন্তায় মরে তার নেংটি নিয়ে। তার কনসার্নটা হলো শুধু নেংটিটা। কিন্তু রাজার তো রাজত্ব পরিচালনা করাটা দায়িত্ব।
আর একটা ঘটনা বলি – কোন এক রায়টের সময় – এলাকার মুচিরা বাড়ির উঠানে ভর্তি মানুষ। পাটের গুদাম হিসেবে যে ঘরগুলো ব্যবহার করা হতো। সেই গুদামগুলো খালি করা হচ্ছে এবং তারা সেখানে থাকবে। তারপর আমার বাবা কামলাদের বলছেন, একটা পাকঘর বানিয়ে দাও। তো, আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন আলাদা করতে হবে? তখন আমার মা বললেন যে, আমাদের পাকঘরে গরু রান্না হয়, ওরা তো হিন্দু। ওদের ধর্মে তো গরু খাওয়া নিষেধ। ওদের আলাদা হাঁড়ি পাতিল, আলাদা পাকঘর করে দিচ্ছি। তখন আমি ছোট আমারও রাগ হলো যে, জানে বাঁচে না আবার কোন পাতিলে রান্না করে খাবে সেটারও হিসেব করে। তখন আমার মা বলল যে, এটা বলতে নেই। অন্যের ধর্ম নষ্ট করা মানুষের কাজ না। – আমার এখনও স্পষ্ট এই কথাটা মনে আছে। আমার মা বাবারা কিন্তু পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। যখন আমাদের এই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয় তখন আমার এই গল্পগুলো মনে পড়ে।


























