পর্ব – ৪
বাংলাদেশে নারী নির্যাতন আগে থেকেই ছিল এখন সচেতনতা বাড়ায় এগুলো প্রকাশিত হচ্ছে
দুটো জিনিস আমাদের বুঝতে হবে। আমাদের দেশে আগেও কিন্তু নারী নির্যাতন ছিল। সেটা ঘরের ভিতরে এবং পাটক্ষেত থেকে শুরু করে, অন্যান্যক্ষেতে যে নির্যাতন হতো এবং এগুলো কিন্তু পত্রিকায় রিপোর্ট হতো না। সেগুলো ঐ পরিসরে হতো! আমি গ্রামের মেয়ে হওয়াতে এবং পরবর্তীতে ছয়টা গ্রামে তিনবছর বিআইডিএস এর কাজ করার কারণে জানি এগুলো। ঐখানে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যে নারী নির্যাতন কি হয়! কিন্তু এগুলো পত্রিকায় আসত না। এটা স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হতো! এখন যেহেতু সচেতনতা বেড়েছে। মেয়েরা বাইরে বেরিয়ে আসছে সেই কারণে সচেতনতাও বেড়েছে এবং নির্যাতনটাও জানা যাচ্ছে।
সুতরাং নির্যাতন ছিল না আগে এটা ঠিক না। নির্যাতন আগেও ছিল। এবং আমরাও নেত্রকোনার মতো যায়গায় টিজিংয়ের শিকার হতাম। শুধু যে আমাদের ভাইয়েরা নেত্রকোনায় নেতৃস্থানীয় ছিল তা বলে নয়, আমাদের বাড়ি একটু প্রমিনেন্ট ছিল সেই হিসাবে কিছুটা ছাড় পেতাম। তারপরেও কিন্তু আমাদের অনেক বেগ পেতে হয়েছে। সুতরাং এটাকে তখন আমরা স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিয়েছি কিন্তু এখন সেটাকে আর স্বাভাবিক ধরা হয়না। সুতরাং এখন যে নৃশংসতা হয়তবা সেটা তখন ছিলনা। পাড়া প্রতিবেশি, গার্জিয়ানদের দেখলে তখন ছেলেমেয়েরা একটু সমীহ করত। এখন সেটা করেনা। শহরের কালচার হলো কেউ কাউকে চেনেনা। আগে তো একটা পারিবারিক রিলেশন ছিল, যেমন মনে আছে নেত্রকোনায় স্কুলে যখন পড়ি ফাইভে না সিক্সে, তখন মৌলভী স্যার জিজ্ঞেস করেছেন। এই মোসলমান কিভাবে হয়? আমরা তো কখনও এই বিষয়টা নিয়ে ভাবিনি। আমরা মোসলমান এইটাই ছোটবেলা থেকে জানি। কিভাবে হয় মোসলমান এটা তো জানিনা। শুধু আমার মাথায় আসল। সম্ভবত এটা ফোরের ঘটনা। আমি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হয়েছি। ওয়ান-টু আমি বাড়িতে চাচার কাছে পড়েছি। আমি জানি তো মুসলমানরা গরু খায়, আর হিন্দুরা গরু খায় না। তখন আমি আমার সাধারণ বুদ্ধিতে যেটা আসছে সেটাই দিলাম যে, স্যার গরু খেয়ে মুসলমান হয়। উনি হো হো করে হেসে দিলেন। দিয়ে বললেন, তুই গরু খাওয়া মোসলমান। এই আমার নাম হয়ে গেল গরু খাওয়া মোসলমান। কিন্তু এখনকার মতো হলে শিক্ষক অভিভাবককে ডাকত ডেকে বলত। এখন আমি জানিনা, তখন উনারা উদারমনস্ক ছিলেন সেটাও হতে পারে, অথবা হতে পারে যে আমার বাবাকে ডেকে এই প্রশ্ন উনি যে করেছেন এই বাচ্চাকে, এটা উনি জানাতে পারতেন না!
দুটোর একটা হতে পারে। এই জিনিসগুলো আমাদের সময়ে হতো। এখন যে অভিভাবকদের ডেকে বলা এটা আমাদের সময়ে ছিলনা এবং কোন বিষয়ে আমি বলতেসি যে, গরু খেয়ে মুসলমান হয়। এখন সেই বিষয়টা শিক্ষকদের মধ্যেও নেই।
পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যবাদ এবং ধর্মীয় আধিপত্যবাদের কাছে পরাজিত হচ্ছে বাংলাদেশের নারী আন্দোলন
আধিপত্যবাদের বিষয়টা, পুরুষতান্ত্রিকতাটা, পুরুষের আধিপত্য। পরিবারেও আধিপত্য, রাজনীতিতেও আধিপত্য। এনজিও কমিউনিটিতে যান, সবখানেই পুরুষের আধিপত্য। আরেকটা হলো ধর্মের আধিপত্য। এই দুই আধিপত্য মিলে নারীর প্রশ্ন আসলে তখন আর গণতন্ত্র নাই। তখন আর সমান অধিকার নাই। তখন হলো ধর্ম। তখন সংবিধানের উপরে ধর্ম আধিপত্য করে এবং সংবিধান বিরোধী কিছু আইন এখনও রয়েছে। উত্তরাধিকার পারিবারিক আইন। এটা যার যার ধর্মের কাছে ছেড়ে দিয়েছে। এটা তো সংবিধান বিরোধী। কারণ, সংবিধানে বলাই আছে, যে সমস্ত আইন এই সংবিধান পাস হওয়ার পর যে সমস্ত আইন সংবিধানের সঙ্গে মেলেনা সেই সমস্ত আইন পরিবর্তন করে ঢেলে সাজাতে হবে। এখন আইনের মধ্যে বৈষম্য থাকলে সমাজে আপনি কি করবেন? যে শিক্ষা ব্যবস্থা এই নারীর সম অধিকারকে প্রায়োরিটি দেয়।
একদিকে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এই প্রশিক্ষণটা কাজে লাগানোর জন্য যে উপযুক্ত পরিবেশ সেটা কিন্তু নাই। পুরো পরিবেশটাই অনুপযুক্ত। এবং অনুপযুক্ত পরিবেশটাকে উপযুক্ত পরিবেশ করতে হলে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে পরিবর্তন আনতে হবে। আইনে আনতে হবে। কারণ, আইন যারা কার্যকর করবে এবং সরকারের টাকা পয়সা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কার্যক্রম যারা ব্যবস্থাপনা করবে তাদের মধ্যে সেই সচেতনতাটা নাই। আমি সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিদের কথা বলছি। যেমন, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি মেইনস্ট্রিমিং বলে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা প্রজেক্ট আছে। মূল প্রজেক্টের নাম হলো জেনারেশন ব্রেক থ্রু। তার যে ডিরেক্টর, উনি ওপেন মিটিংয়ে বলছেন যে শ্বাশুড়িকে দেখে বউয়ের হাত কেঁপে পানির গ্লাস হাত থেকে পড়ে যাবে। শ্বাশুড়িকে দেখে ভয়ে বউয়ের হাত কাপতে কাপতে গ্লাসটা পড়ে যাবে এটাই হলো বাংলাদেশের সৌন্দর্য্য। এটাই হলো আমাদের সংস্কৃতি। উনি হচ্ছেন এই প্রোজেক্টের ডিরেক্টর। সুতরাং এমন দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে কিভাবে এগুলো ঠিক হবে? সুতরাং এই মন মানসিকতার যারা সরকারি চাকরি করছে, সরকারি কর্মকর্তা যারা জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি মেইনস্ট্রিমিংয়ে আছে, সেখানে আমাদের এই অবস্থা তাহলে অন্যদের কি অবস্থা! অনেক সচিব আছেন, ইভেন মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে যারা আছেন, তারা যে সমস্ত কথাবার্তা বলেন, নারীর সমানাধিকার এবং পুরুষের আধিপত্য বিষয়টা নিয়ে তাদের কোন রকমের চিন্তাভাবনা নাই। তাহলে কিভাবে অত্যাচার নির্যাতন কমবে। শুধু পুলিশ দিয়ে তো হবে না! কয়জনকে আপনি ফাঁসি দিবেন। ধর্ষককে অবশ্যই ফাঁসি দেয়া দরকার এবং কেউ কেউ বলছেন, ফাঁসি যদি না দিতে হয়, তাহলে তাদেরকে খোঁজা করে দেয়া হোক। সারাজীবন তারা ভুগুক। ক্রসফায়ার আর খোঁজা করা। যারা মানবাধিকারের কথা বলেন, ক্রসফায়ার বা ফাঁসি দিতে চাননা। তাহলে খোঁজা করুক। যাতে জীবনে আর এই ধরণের কাজ করতে না পারে। সুতরাং এই ব্যবস্থাপনাগুলোর মধ্যে যদি বলবৎ থাকে তাহলে মানুষের মন মানসিকতায় থাকে, তাহলে মানুষ যদি পুরুষের আধিপত্যবাদী মানসিকতা পরিবর্তনে যদি শিক্ষা এবং সব যায়গায় ব্যবস্থাপনা সেটা পরিবর্তন আনতে হবে।
আগামীকাল প্রকাশিত হবে পঞ্চম পর্ব। এই সাক্ষাতকারটি ২০২০ সালে নেয়া।


























