◉ অস্থিতিশীল পরিস্থিতে কমেছে নিয়মিত আয়
◉ ৪ কোটি ১০ লাখ পরিবার মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করছেন : বিবিএস
➥উৎপাদন স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে বাজার ব্যবস্থাপনা খুব দুর্বল : ড. মোস্তাফিজুর রহমান, অর্থনীতিবিদ
➥ বাজার নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে : ড. জাহাঙ্গীর আলম খান, কৃষি অর্থনীতিবিদ
➥গত দুই-তিন বছরে সাধারণ ভোক্তাদের আয় কিন্তু বাড়েনি, এই সময়ে কর্মহীন ও দারিদ্র্যসীমার নিচেও গেছে অনেক মানুষ : মো. খলিলুর রহমান সজল, নির্বাহী পরিচালক, ভোক্তা
দেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলছে। একের পর এক সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সবাই লাগামহীনভাবে বাজারের সব পণ্যের দাম বাড়িয়েছেন। চাল, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, মাছ-মাংস, সবজিসহ অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম স্বল্পআয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। মূল্যস্ফীতির পারদ এখনো অসহনীয় পর্যায়েই রয়ে গেছে। এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে জনজীবনে। প্রতিনিয়ত সবকিছুর দাম বাড়লেও বাড়েনি সব সাধারণ মানুষের আয়। বরং আয়ের চেয়ে ব্যয় কয়েকগুণ বাড়ার কারণে সংসারের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এদিকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসেনি, বরং প্রতিনিয়ত সবকিছুর দাম বেড়ে চলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই দায়ী।
এদিকে দেশের চলমান নানা অস্থিরতা ঘিরে বিভিন্ন সময় অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বেড়ে চলছে। চলমান আন্দোলনকে ঘিরে ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় অর্থনীতিতে বড় ক্ষতি হয়েছে। বিশেষত ডলার সংকটের এই সময়ে পণ্য আমদানি এখনো পর্যাপ্ত নয়। দেশে রেমিট্যান্সসহ বৈদেশিক মুদ্রার আয় না বাড়লে আমদানি আরো কমতে পারে। এতে সরবরাহ সংকটে আমদানি পণ্যসহ দেশীয় পণ্যের দামও বাড়তে পারে। মূল্যস্ফীতি বাড়লেও অর্থনৈতিক মন্দার কারণে গত দু-তিন বছরে ভোক্তার প্রকৃত আয় বাড়েনি। ভোক্তার আয় যে হারে বেড়েছে, এর চেয়ে বেশি বেড়েছে ব্যয়। এতে এখন নিম্ন আয়ের মানুষই শুধু নয়, মধ্যবিত্তরাও সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। তিন বছর ধরে এই প্রবণতা চলায় ভোক্তাদের যেমন ঋণ নেওয়ার হার বেড়েছে, তেমনি তারা ঋণ গ্রহণের সক্ষমতাও হারিয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সাধারণত তাদের ব্যবসায়ীক মূলধনের যোগান দিতে ব্যাংক ঋণ নিয়ে থাকে। কিন্তু চলমান বিভিন্ন সহিংসতার কারণে তাদের দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে।
চলতি বছরের মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৪ কোটি ১০ লাখ পরিবারের ২৬ শতাংশ মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে চলছে। অর্থসংকটে মৌলিক খাদ্য কেনা কমিয়ে দেওয়ায় দরিদ্র মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, ২০২২ সালের জুলাইয়ে ডলারের দাম ছিল ৮৫ টাকা, এখন তা প্রায় ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত দুই বছরের ব্যবধানে ডলারের মূল্য বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। টাকার এই অবমূল্যায়ন ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে, বাড়িয়ে দিয়েছে পণ্যের দাম। এরপর রয়েছে নিত্যপণ্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদরের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাঝারি মানের চাল ব্রি-২৮ ও পাইজাম খুচরায় প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৪৪ থেকে ৫০ টাকায়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজারে বিক্রি হয় ৫৮ থেকে ৬০ টাকায়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে খুচরায় প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয় ১৮ থেকে ২৫ টাকায়, খোলা চিনি প্রতি কেজি বিক্রি হয় ৬২ থেকে ৬৫ টাকায় এবং ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি বিক্রি হয় ১১০ থেকে ১২৫ টাকায়। গত ২৮ জুলাই রাজধানীর খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়, প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হয় ১৪০ টাকায় এবং ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়।
দেশে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘দেশে আমদানি থেকে ভোক্তা এবং উৎপাদন স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে বাজার ব্যবস্থাপনা খুব দুর্বল। চাহিদা ও সরবরাহ, সরকারের নিজস্ব মজুদ ও আমদানির মধ্যে সমন্বয় থাকলে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি কিছুটা কমানো যেত। চাহিদা অনুযায়ী ব্যবসায়ীরা আমদানির এলসি খুলতে পারছেন না। ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোরও আমদানির সক্ষমতা কমে গেছে। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগতভাবে ক্ষয় হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টারি কনজিউমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়্যারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল বলেন, ‘ভোক্তারা ন্যায্য দামে পণ্য পেতে চায়, কিন্তু তারা সেটি পাচ্ছে না। এটার বড় যে কারণ সেটাই হচ্ছে আমাদের অনিয়ন্ত্রিত ও অপনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা। গত দু-তিন বছরে সাধারণ ভোক্তাদের আয় কিন্তু বাড়েনি। এই সময়ে কর্মহীন হয়েছে প্রচুর মানুষ, দারিদ্র্যসীমার নিচেও গেছে অনেক মানুষ। এ কারণে অনেক মানুষ এখন তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছে না।’
নিত্যপণ্যের এই লাগামহীন অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইরে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘দেশের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অবশ্যই খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের খাদ্যশস্যের মজুত সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। যখন বাজারে ঘাটতি দেখা দেবে, তখন যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী সরবরাহ করা যায়। আমদানি করে হলেও বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে।’


























