◉ অবিলম্বে নতুন কারিকুলাম বাতিল করে সৃজনশীলের আগের পদ্ধতি চালুর দাবি অনেকের
◉ নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করে জনপ্রত্যাশার আলোকে কারিকুলাম চায় শিক্ষক ফোরাম
◉ নতুন কারিকুলামের কিছু কার্যক্রম স্থগিত করেছে এনসিটিবি
শিক্ষার্থীদের তুমুল আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের পাশাপাশি শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন এই সরকার দেশ সংস্কারের কাজ শুরু করেছে। এ অবস্থায় দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা খাতেও সংস্কারের জোর দাবি উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে। বিশেষ করে চরম বিরোধিতার মুখেও গত বছর থেকে চালু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করে জনপ্রত্যাশার আলোকে কারিকুলামের দাবিতে গতকাল রাজধানীতে মানববন্ধন করেছে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম। মোটকথা কারিকুলামকে যুগোপযোগী করার দাবি সবার। এছাড়া ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ, পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন, কোচিং বন্ধ, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধসহ নানা ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি উঠেছে। যদিও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নতুন কারিকুলাম সংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণসহ কিছু কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। তবে কারিকুলাম বাতিলের সিদ্ধান্ত নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার শিক্ষায় রূপান্তরের অংশ হিসেবে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে গত বছর থেকে নতুন কারিকুলাম চালু করে। ওই বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তিনটি শ্রেণিতে এবং চলতি বছর আরও চারটি শ্রেণিতে এই শিক্ষাক্রম কার্যকর হয়েছে। পর্যায়ক্রমে উচ্চমাধ্যমিকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা। তবে তেমন প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই সম্পূর্ণ নতুন ধাচের এই কারিকুলাম চালুর শুরু থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন শিক্ষক-অভিভাবকরা। তবে সরকার তাতে কোনো সাড়া না দিয়ে তা বহালের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ায় সংশ্লিষ্টরা সেই কারিকুলাম বাতিলের দাবি জোরদার করেছেন।
সংশ্লিষ্টদের দাবি- নতুন কারিকুলামে মুখস্ত ও লেখাপড়া এবং গতানুগতিক পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে হাতে-কলমের কাজ এবং শিখনকালীন ও সামষ্টিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখা হয়েছে। যাতে কোনো মতেই খাপ খাওয়াতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা এবং এতে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া বিমুখ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই এসব পদ্ধতি বাদ দিয়ে সৃজনশীলের আগের তথা নব্বই দশকে যে পদ্ধতি চালু ছিল তা চালু করার দাবি জানিয়েছেন অনেকে। কারণ ওই পদ্ধতিতেই দেশের শিক্ষার্থীরা দেশের পাশাপাশি বিদেশেও মেধার স্বাক্ষর রাখছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ সবুজ বাংলাকে বলেন, নতুন কারিকুলাম অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়া ধ্বংসের মুখে পড়ছে। আগের গতানুগতিক কারিকুলাম চালু করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান নিশ্চিত করা, কোচিং নির্ভরতা কমানো এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসম্মত শিক্ষক নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি।
এদিকে শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ, নতুন শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয়, মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরগুলোতে আওয়ামীপন্থিদের পদত্যাগ চান বেশ কয়েকজন অভিভাবক। আর শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বৃদ্ধি করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন অনেকে। এছাড়া ছাত্ররাজনীতি, র্যাগিং ও গেস্টরুম প্রথা বাতিল চান সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধও ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে শিক্ষা ও গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন অনেকে। মোহাম্মদ আরিফ হোসেনের মতে, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে শিক্ষার্থীদের কাজে অগ্রাধিকার দিতে হবে, শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা দিতে হবে সার্বক্ষণিক, পড়াশুনায় দলভিত্তিক কোনোরকম প্রশ্ন থাকা যাবে না, গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে, ঘুষ প্রথা বাতিল করতে হবে, কোথাও শিক্ষার্থী-শিক্ষক হেনস্থার শিকার হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে, শিক্ষকদের ক্ষমতা দ্বারা প্রভাবিত করা যাবে না, সর্বদা মেধার মূল্যায়ন করতে হবে ও সরকারি সেবায় শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্কুল ফি সহনীয় করার দাবি জসিম উদ্দিনের। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দুর্নীতি বন্ধের দাবি ফাহিম ইসলামের। সোফি আয়াহ অফিস কর্মকর্তাদেরকে অতিরিক্ত বকশিস (ঘুষ) বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। কর্মমুখী ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করার কথা বলেছেন কেউ কেউ। তারা বলেছেন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। যোগ্য, মেধাবী শিক্ষকদের নিয়োগ দিতে হবে। গবেষণামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে।
সূত্রমতে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনো পর্যায়ে রাজনীতি না রাখার পক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি থাকলেও তা নিয়োগ বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে প্রভাবিত করতে পারবে না। কলূষিত রাজনীতি যেন না হয়। তবে রাজনীতি ছিল বলেই ছাত্ররা জেগে উঠেছে। যদিও কোনো সংগঠন নয়, তারা নিজেরাই রাজনীতি সচেতন থেকে এই আন্দোলন সফল করেছে।
এতদিন শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়ায় মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ওবায়দুল ইসলাম বলেন, দেশের পুরো কোর্স-কারিকুলাম বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে ঢেলে সাজাতে হবে। পরীক্ষা ছাড়া মূল্যায়ন বন্ধ করতে হবে। পরীক্ষা ছাড়া জাজমেন্ট বা মূল্যায়ন করা যাবে না। এ সময় সব পর্যায়ের শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নয়, কিছু কার্যক্রম স্থগিত : নতুন শিক্ষা কারিকুলাম নয় কারিকুলামের কিছু কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। নতুন শিক্ষা কারিকুলামের অধীনে কর্মশালা, প্রশিক্ষণ, গবেষণা পরিমার্জন ও সংশোধন কাজ স্থগিত করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। শনিবার এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম এই তথ্য নিশ্চিত করেন এবং আরও বলেন, রোববার থেকে বগুড়ায় আমাদের কর্মশালা শুরু হওয়ার কথা ছিল সেটি আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। আর শিক্ষা কারিকুলাম বাতিল এনসিটিবি করতে পারে না। এটা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ।
নতুন শিক্ষাক্রম অনতিবিলম্বে বাতিল করুন : জাতীয় শিক্ষক ফোরাম এর কেন্দ্রীয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বলেছেন, নতুন কারিকুলাম বাতিল করতে হবে। সেই সঙ্গে নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করে জনগণের প্রত্যাশার আলোকে কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। গতকাল শনিবার বিকাল ৩টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে জাতীয় শিক্ষক ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির আয়োজনে ‘গণহত্যার বিচার, শিক্ষা কারিকুলাম বাতিল ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবিতে’ মানববন্ধন কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
জাতীয় শিক্ষক ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক নাছির উদ্দীন খান এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে গণহত্যার বিচার এবং আহত সব ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসার দায়িত্বভার গ্রহণ করার জন্য নতুন সরকারের নিকট দাবি জানানো হয়। মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে আগামী ১৭ আগস্ট শনিবার জেলায় জেলায় ‘গণহত্যার বিচার, কারিকুলাম বাতিল, শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।


























