০৫:০৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

৫ অক্টোবর ২০২৪ইং ৩০তম বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে শিক্ষার অগ্রগতি, মানবজাতির ক্রমোন্নতি এবং আধুনিক সমাজের বিকাশ সাধনে শিক্ষক সমাজের অপরিহার্য ভূমিকা ও অবদানের কথা জোরের সাথে ঘোষণা করে শিক্ষকগণ যাতে এসব ভূমিকা পালনের জন্য উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করতে পারেন তা সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়েছে।
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর উদ্যোগে শিক্ষকদের মর্যাদা সম্পর্কে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক বিশেষ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলন বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা বিষয়ক আন্তর্জাতিক দলিল ‘ইউনেস্কো/আইএলও সনদ’ স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত দিবসটি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। একটি উন্নত জাতি গঠনে প্রয়োজন সুশিক্ষকের। অর্জিত জ্ঞান ও লব্ধ অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের আচরণের যে পরিবর্তন তাতে উন্নতির পথে অগ্রসর করে সফল সার্থক জীবন যাপনে সাহায্য করে সুশিক্ষা। সুশিক্ষা মানুষের মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটায়, নীতিবোধ ও মূল্যবোধ জাগ্রত করে। সুশিক্ষায় মানুষকে আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সুশিক্ষায় মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশের বিরাট জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে শিক্ষক মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন।
একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতিতে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষার্থীর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে শিক্ষকের। একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থী অনুকরণ করে। যোগ্যতা, দেশপ্রেম দায়িত্ববোধের সাথে যদি শিক্ষকগণ যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন তবে সমগ্র জাতিই হয়ে পড়ে বিপন্ন। একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীর নিকট হতে হবে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। একজন শিক্ষার্থীর সুপ্ত গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে পারে একজন শিক্ষক। শিক্ষার্থীর মধ্যে যে গুণাবলী বিদ্যমান সেভাবে শিক্ষার্থীকে দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে একজন শিক্ষকের সমকক্ষ অন্য কেউ হতে পারে না। যিনি শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকতে হবে শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নতি সাধন কিভাবে করা যায়। সুশিক্ষার জন্য প্রথমে বলেছি সুশিক্ষক প্রয়োজন। সুশিক্ষককে অনেক গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। এজন্য মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক নিশ্চয়তা না থাকলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই পেশায় আকৃষ্ট হতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে মেধাবী ছাত্ররা বিভিন্ন পেশায় চলে যান। তার অন্যতম কারণ শিক্ষকতা পেশায় আর্থিক অস্বচ্ছলতা, চাকরির নিরাপত্তহীনতা আর সামাজিক অমর্যাদা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় “একটি বেসরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষককে একদিন এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেন, আপনি কি এখন কোন চাকরি করেন? প্রধান শিক্ষক উত্তরে বললেন আমি তো একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তখন ব্যক্তিটি বললেন, আপনি অন্য কোন চাকরি পেলেন না। এখনও বেকারই রয়ে গেলেন।” আসলে বেসরকারি স্কুলের চাকরিকে অনেকেই চাকরি মনে করেন না। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে একজন শিক্ষকের প্রতি ছাত্র ও অভিভাবকদের যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল, এখন সে শ্রদ্ধাবোধ নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দলাদলি, শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাসের ফলে মেধাবীরা এই পেশার প্রতি আগ্রহ দেখাতে চান না। লেখাপড়া জানে না এমন ব্যক্তিরাও অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজাধিরাজ। উদাহরণ আছে এক বিদ্যালয়ে এক সদস্য প্রধান শিক্ষকের কক্ষে এসে বললেন, “আপনি অমুক মাস্টারকে ডাকেন, প্রধান শিক্ষক বললেন কি ব্যাপার আমাকে বলুন। তখন সদস্য বললেন অমুক মাষ্টার লেখাপড়া জানে না। কারণ সে পরীক্ষার খাতায় এক ছাত্রকে ২টি ০ (শূন্য) দিয়েছে। ছাত্র যদি কিছু না জানে তাকে একটি শূন্য দিত, ২টি শূন্য সে জেদ করে দিয়েছে এজন্য তাকে শাস্তি দিন।” এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাস করা মেধাবী ছাত্র যদি শিক্ষকতা পেশায় আসে আর তাকে যদি বিদ্যালয় থেকে কোন বেতন না দেয়া হয় তাহলে নিজেই কি খাবে আর তার পরিবারকেই বা কি খাওয়াবে। বেতনের সরকারি অংশ পেতে অনেক বিলম্ব হয়। তাইতো শিক্ষকতা পেশায় অনেক ক্ষেত্রেই অনাকাক্সিক্ষতরা এসে যায়। তাদের দ্বারা কি সুশিক্ষা দেয়া সম্ভব? অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে ডোনেশান প্রথা। এই ডোনেশান প্রথায় যারা শিক্ষকতা পেশায় আসেন তারা কীভাবে সুশিক্ষা দান করবে। এটা ভাবতে হবে দেশ ও জাতিকে। সুশিক্ষার জন্য চাই সুশিক্ষক। এজন্য থাকবে না কোন বৈষম্য। আমাদের দেশে শতকরা ৯৯ ভাগ শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার দায় দায়িত্ব বহন করে বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু বেসরকারী স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল থেকে একই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল অনেক বেশী। বর্তমানে এমপিও ভুক্ত বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীরা সরকার থেকে স্কেলের ১০০% বেতন পান। শিক্ষকরা ২টি ঈদে ৫০% এবং কর্মচারীরা ১০০% উৎসব ভাতা পান। প্রতিষ্ঠান থেকেও বিভিন্ন ভাতাদি পেয়ে থাকেন। বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ এখন সময়ের দাবী। শিক্ষক কর্মচারীদের চাকুরী জাতীয়করণ করতে হলে সরকারের আর্থিক ক্ষতিও খুব একটা হবে না। সেজন্য নিম্নে একটি হিসাব দেয়া হলো :
বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা:
ক্রঃনং প্রতিষ্ঠানসমূহ সংখ্যা
১ স্কুল ১৭৪১
২ কলেজ ২৮১৪
৩ মাদ্রাসা ৮২২১
৪ এসএসসি কারিগরি ২২৮৭
এইচএসসি কারিগরি
মোট৩০৭৮৩
ক্রঃনং প্রতিষ্ঠানসমূহ সংখ্যা
১ স্কুল ২৭২৫২৭
২ কলেজ ১১৬১৫৭
৩ মাদ্রাসা ১৭৬৭৪১
৪ এসএসসি কারিগরি ২১৮৮৬
এইচএসসি কারিগরি
মোট৬৪৭৩১১
বর্তমানে শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে ১০০% বেতন পান। এজন্য সরকারকে বেতন ভাতা সহ প্রদান করতে হয় প্রতি মাসে
১২৭৭ কোটি ৯৬ লাখ ৯৪ হাজার ৪০০ ৮৯ টাকা মাত্র।
* ১২ মাসে সরকারকে দিতে হয় ১৫৩৩৬ কোটি টাকা প্রায় বেতন ভাতা বাবদ : উৎসব ভাতা ৭৫০ কোটি, বৈশাখী ভাতা ২৩০ কোটি টাকা ও বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৫১ কোটি সহ মোট ১৬৩৮৭ কোটি টাকা।
শিক্ষক কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণের জন্য সরকারকে প্রদান করতে হবে
বেতন ভাতা বাবদ : ১৭৫৭১ কোটি টাকা প্রায়
৫৫৩০০৯ জন শিক্ষক কর্মচারীর চিকিৎসা ভাতা অতিরিক্ত : ৫০০ কোটি টাকা প্রায়
বাড়ী ভাড়া গড় হিসাবে অতিরিক্ত : ৫০০০ কোটি টাকা প্রায়
২টি উৎসব ভাতা : ২০০০ কোটি টাকা প্রায়
বৈশাখী ভাতা : ৫০০ কোটি টাকা প্রায়
মোট= ২৫৫৭১ কোটি টাকা
প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারের আয় হবে:
১. ছাত্র-ছাত্রী বেতন : ২ কোটি ছাত্র থেকে মাসে ১০০ টাকা হিসাবে বৎসরে : ২৪০০ কোটি টাকা প্রায়
২. সেশন চার্জ: গড়ে প্রতি ছাত্র ১৫০০ টাকা হিসাবে: ৩০০০ কোটি টাকা প্রায়
৩. প্রতিষ্ঠানের সম্পদ থেকে বাৎসরিক আয়
(যেমন গাছ বিক্রি, দোকান ভাড়া, পুকুর লীজ, মাঠ ভাড়া ইত্যাদি) : ৭০০ কোটি টাকা প্রায়
৪. সাধারণ তহবিল থেকে আয় কমপক্ষে : ১০০০ কোটি টাকা প্রায়
৫. রিজার্ভ ফান্ড থেকে আয় : ৭০০ কোটি টাকা প্রায়
মোট= ৭৮০০ কোটি টাকা
প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হলে সরকারকে প্রদান করতে হবে মোট ২৫৫৭১ কোটি টাকা। বর্তমানে সরকার বেতন ভাতা বাবদ প্রদান করছে ১৭৫৭১ কোটি টাকা। অতিরিক্ত প্রদান করতে হবে ৮০০০ (আট হাজার) কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারের আয় হবে ৬৮৪০ কোটি টাকা।
ডিগ্রী পর্যায়ে পর্যন্ত শিক্ষক কর্মচারীদের জাতীয়করণ করলে সরকারের অতিরিক্ত লাগবে ৮০০০-৭৮০০ = ২০০ কোটি টাকা প্রায়। বর্তমানে যে হারে শিক্ষকরা নির্যাতিত হচ্ছেন এবং চাকরি হারাচ্ছেন তা ভাষায় বর্ণনা দেয়া যায় না। সরকারি দলের লোকেরা অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অযোগ্য ব্যক্তিদের চাকুরী দিচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট ও সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি
জনপ্রিয় সংবাদ

লালমনিরহাটে ৬ ঘণ্টা পর স্বাভাবিক হলো ট্রেন চলাচল

বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষকদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

আপডেট সময় : ০৭:০৭:৪২ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ অক্টোবর ২০২৪
৫ অক্টোবর ২০২৪ইং ৩০তম বিশ্ব শিক্ষক দিবস। ১৯৪৮ সালে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে শিক্ষার অগ্রগতি, মানবজাতির ক্রমোন্নতি এবং আধুনিক সমাজের বিকাশ সাধনে শিক্ষক সমাজের অপরিহার্য ভূমিকা ও অবদানের কথা জোরের সাথে ঘোষণা করে শিক্ষকগণ যাতে এসব ভূমিকা পালনের জন্য উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা ভোগ করতে পারেন তা সুনিশ্চিত করার অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়েছে।
১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর উদ্যোগে শিক্ষকদের মর্যাদা সম্পর্কে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক বিশেষ আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকার সম্মেলন বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা বিষয়ক আন্তর্জাতিক দলিল ‘ইউনেস্কো/আইএলও সনদ’ স্বাক্ষরিত হয়। উক্ত দিবসটি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। একটি উন্নত জাতি গঠনে প্রয়োজন সুশিক্ষকের। অর্জিত জ্ঞান ও লব্ধ অভিজ্ঞতার ফলে মানুষের আচরণের যে পরিবর্তন তাতে উন্নতির পথে অগ্রসর করে সফল সার্থক জীবন যাপনে সাহায্য করে সুশিক্ষা। সুশিক্ষা মানুষের মানবীয় গুণাবলীর বিকাশ ঘটায়, নীতিবোধ ও মূল্যবোধ জাগ্রত করে। সুশিক্ষায় মানুষকে আদর্শ নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে। সুশিক্ষায় মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দেশের বিরাট জনসংখ্যাকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে শিক্ষক মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন।
একটি জাতির উন্নতি ও অগ্রগতিতে শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষার্থীর কাছে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে শিক্ষকের। একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থী অনুকরণ করে। যোগ্যতা, দেশপ্রেম দায়িত্ববোধের সাথে যদি শিক্ষকগণ যথাযথ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন তবে সমগ্র জাতিই হয়ে পড়ে বিপন্ন। একজন শিক্ষককে শিক্ষার্থীর নিকট হতে হবে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। একজন শিক্ষার্থীর সুপ্ত গুণাবলীর বিকাশ ঘটাতে পারে একজন শিক্ষক। শিক্ষার্থীর মধ্যে যে গুণাবলী বিদ্যমান সেভাবে শিক্ষার্থীকে দিক নির্দেশনা দিয়ে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে একজন শিক্ষকের সমকক্ষ অন্য কেউ হতে পারে না। যিনি শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন তার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য থাকতে হবে শিক্ষার্থীর সার্বিক উন্নতি সাধন কিভাবে করা যায়। সুশিক্ষার জন্য প্রথমে বলেছি সুশিক্ষক প্রয়োজন। সুশিক্ষককে অনেক গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে। এজন্য মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে হবে। শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক নিশ্চয়তা না থাকলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এই পেশায় আকৃষ্ট হতে চান না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে মেধাবী ছাত্ররা বিভিন্ন পেশায় চলে যান। তার অন্যতম কারণ শিক্ষকতা পেশায় আর্থিক অস্বচ্ছলতা, চাকরির নিরাপত্তহীনতা আর সামাজিক অমর্যাদা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় “একটি বেসরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষককে একদিন এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেন, আপনি কি এখন কোন চাকরি করেন? প্রধান শিক্ষক উত্তরে বললেন আমি তো একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তখন ব্যক্তিটি বললেন, আপনি অন্য কোন চাকরি পেলেন না। এখনও বেকারই রয়ে গেলেন।” আসলে বেসরকারি স্কুলের চাকরিকে অনেকেই চাকরি মনে করেন না। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে একজন শিক্ষকের প্রতি ছাত্র ও অভিভাবকদের যে শ্রদ্ধাবোধ ছিল, এখন সে শ্রদ্ধাবোধ নেই বললেই চলে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দলাদলি, শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাসের ফলে মেধাবীরা এই পেশার প্রতি আগ্রহ দেখাতে চান না। লেখাপড়া জানে না এমন ব্যক্তিরাও অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজাধিরাজ। উদাহরণ আছে এক বিদ্যালয়ে এক সদস্য প্রধান শিক্ষকের কক্ষে এসে বললেন, “আপনি অমুক মাস্টারকে ডাকেন, প্রধান শিক্ষক বললেন কি ব্যাপার আমাকে বলুন। তখন সদস্য বললেন অমুক মাষ্টার লেখাপড়া জানে না। কারণ সে পরীক্ষার খাতায় এক ছাত্রকে ২টি ০ (শূন্য) দিয়েছে। ছাত্র যদি কিছু না জানে তাকে একটি শূন্য দিত, ২টি শূন্য সে জেদ করে দিয়েছে এজন্য তাকে শাস্তি দিন।” এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাস করা মেধাবী ছাত্র যদি শিক্ষকতা পেশায় আসে আর তাকে যদি বিদ্যালয় থেকে কোন বেতন না দেয়া হয় তাহলে নিজেই কি খাবে আর তার পরিবারকেই বা কি খাওয়াবে। বেতনের সরকারি অংশ পেতে অনেক বিলম্ব হয়। তাইতো শিক্ষকতা পেশায় অনেক ক্ষেত্রেই অনাকাক্সিক্ষতরা এসে যায়। তাদের দ্বারা কি সুশিক্ষা দেয়া সম্ভব? অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে ডোনেশান প্রথা। এই ডোনেশান প্রথায় যারা শিক্ষকতা পেশায় আসেন তারা কীভাবে সুশিক্ষা দান করবে। এটা ভাবতে হবে দেশ ও জাতিকে। সুশিক্ষার জন্য চাই সুশিক্ষক। এজন্য থাকবে না কোন বৈষম্য। আমাদের দেশে শতকরা ৯৯ ভাগ শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার দায় দায়িত্ব বহন করে বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু বেসরকারী স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল থেকে একই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষকের বেতন স্কেল অনেক বেশী। বর্তমানে এমপিও ভুক্ত বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীরা সরকার থেকে স্কেলের ১০০% বেতন পান। শিক্ষকরা ২টি ঈদে ৫০% এবং কর্মচারীরা ১০০% উৎসব ভাতা পান। প্রতিষ্ঠান থেকেও বিভিন্ন ভাতাদি পেয়ে থাকেন। বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ এখন সময়ের দাবী। শিক্ষক কর্মচারীদের চাকুরী জাতীয়করণ করতে হলে সরকারের আর্থিক ক্ষতিও খুব একটা হবে না। সেজন্য নিম্নে একটি হিসাব দেয়া হলো :
বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা:
ক্রঃনং প্রতিষ্ঠানসমূহ সংখ্যা
১ স্কুল ১৭৪১
২ কলেজ ২৮১৪
৩ মাদ্রাসা ৮২২১
৪ এসএসসি কারিগরি ২২৮৭
এইচএসসি কারিগরি
মোট৩০৭৮৩
ক্রঃনং প্রতিষ্ঠানসমূহ সংখ্যা
১ স্কুল ২৭২৫২৭
২ কলেজ ১১৬১৫৭
৩ মাদ্রাসা ১৭৬৭৪১
৪ এসএসসি কারিগরি ২১৮৮৬
এইচএসসি কারিগরি
মোট৬৪৭৩১১
বর্তমানে শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকার থেকে ১০০% বেতন পান। এজন্য সরকারকে বেতন ভাতা সহ প্রদান করতে হয় প্রতি মাসে
১২৭৭ কোটি ৯৬ লাখ ৯৪ হাজার ৪০০ ৮৯ টাকা মাত্র।
* ১২ মাসে সরকারকে দিতে হয় ১৫৩৩৬ কোটি টাকা প্রায় বেতন ভাতা বাবদ : উৎসব ভাতা ৭৫০ কোটি, বৈশাখী ভাতা ২৩০ কোটি টাকা ও বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৫১ কোটি সহ মোট ১৬৩৮৭ কোটি টাকা।
শিক্ষক কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণের জন্য সরকারকে প্রদান করতে হবে
বেতন ভাতা বাবদ : ১৭৫৭১ কোটি টাকা প্রায়
৫৫৩০০৯ জন শিক্ষক কর্মচারীর চিকিৎসা ভাতা অতিরিক্ত : ৫০০ কোটি টাকা প্রায়
বাড়ী ভাড়া গড় হিসাবে অতিরিক্ত : ৫০০০ কোটি টাকা প্রায়
২টি উৎসব ভাতা : ২০০০ কোটি টাকা প্রায়
বৈশাখী ভাতা : ৫০০ কোটি টাকা প্রায়
মোট= ২৫৫৭১ কোটি টাকা
প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারের আয় হবে:
১. ছাত্র-ছাত্রী বেতন : ২ কোটি ছাত্র থেকে মাসে ১০০ টাকা হিসাবে বৎসরে : ২৪০০ কোটি টাকা প্রায়
২. সেশন চার্জ: গড়ে প্রতি ছাত্র ১৫০০ টাকা হিসাবে: ৩০০০ কোটি টাকা প্রায়
৩. প্রতিষ্ঠানের সম্পদ থেকে বাৎসরিক আয়
(যেমন গাছ বিক্রি, দোকান ভাড়া, পুকুর লীজ, মাঠ ভাড়া ইত্যাদি) : ৭০০ কোটি টাকা প্রায়
৪. সাধারণ তহবিল থেকে আয় কমপক্ষে : ১০০০ কোটি টাকা প্রায়
৫. রিজার্ভ ফান্ড থেকে আয় : ৭০০ কোটি টাকা প্রায়
মোট= ৭৮০০ কোটি টাকা
প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হলে সরকারকে প্রদান করতে হবে মোট ২৫৫৭১ কোটি টাকা। বর্তমানে সরকার বেতন ভাতা বাবদ প্রদান করছে ১৭৫৭১ কোটি টাকা। অতিরিক্ত প্রদান করতে হবে ৮০০০ (আট হাজার) কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারের আয় হবে ৬৮৪০ কোটি টাকা।
ডিগ্রী পর্যায়ে পর্যন্ত শিক্ষক কর্মচারীদের জাতীয়করণ করলে সরকারের অতিরিক্ত লাগবে ৮০০০-৭৮০০ = ২০০ কোটি টাকা প্রায়। বর্তমানে যে হারে শিক্ষকরা নির্যাতিত হচ্ছেন এবং চাকরি হারাচ্ছেন তা ভাষায় বর্ণনা দেয়া যায় না। সরকারি দলের লোকেরা অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অযোগ্য ব্যক্তিদের চাকুরী দিচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেসরকারী শিক্ষক কর্মচারীদের চাকরি জাতীয়করণ করতে হবে।
লেখক : চেয়ারম্যান, শিক্ষক কর্মচারী ঐক্যজোট ও সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি