◉১১ বোর্ডে গড় পাস ৭৭.৭৮, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১
◉ জিপিএ-৫ ও পাসে মেয়েরাই এগিয়ে
◉ সবার শীর্ষে মাদরাসা বোর্ড, পিছিয়ে কম ময়মনসিংহে
◉ ৬৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করেনি, ১৩৮৮ টিতে শতভাগ পাস
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল গতকাল প্রকাশিত হয়েছে। মাদ্রাসা ও কারিগরিসহ দেশের ১১টি শিক্ষাবোর্ডে এবার পাস করেছে ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৩০৯ জন শিক্ষার্থী। গড় পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি সব বোর্ডের ফলাফলের যে সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে তাতে দেখা যায়, গত বছর ১১টি বোর্ডে গড় পাসের হার ছিল ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সেই হিসেবে পাসের হারও কিছুটা কমেছে। জিপিএ ৫ পেয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন। গত বছর অর্থাৎ, ২০২৩ সালে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৯২ হাজার ৩৬৫ জন শিক্ষার্থী। সেই হিসেবে এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে।
অন্যান্যবার নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে এইচএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ করা হলেও এবার তাতে ছিল ভিন্ন আমেজ। মঙ্গলবার বেলা ১১টায় দেশের ১১ শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশ একসঙ্গে অনলাইন, শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইট এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকাশ করা হয়। এছাড়া আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি ফলাফলের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে। এবার ৯ হাজার ১৯৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে।
সূত্রমতে, এবার পরীক্ষার্থীদের একাংশের চাপের মুখে মাঝপথে বাতিল করা হয়েছিল এইচএসসিতে স্থগিত হয়ে পড়া কয়েকটি বিষয়ের পরীক্ষা। এ অবস্থায় ইতিমধ্যে যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়ে গিয়েছিল, সেগুলোর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়েছে। আর যেসব বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি, সেগুলোর ফলাফল তৈরি হয়েছে পরীক্ষার্থীদের এসএসসি বা সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বিষয় ম্যাপিং করে।
এই প্রক্রিয়ায় প্রকাশিত ফলাফলে অনেকের ধারণা ও আশা ছিল পাসের হার অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উল্টো নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষায় গড় পাসের হার গতবারের চেয়ে কমে গেছে। তবে ফলাফলের সর্বোচ্চ সূচক জিপিএ-৫ পাওয়ার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে গড় ফলাফলেও একই ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। অর্থাৎ পাসের হার কমেছে। কিন্তু জিপি-৫ বেড়েছে।
মঙ্গলবার ভিন্ন ব্যবস্থায় এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে। অন্যান্য সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে ফল প্রকাশের কার্যক্রম উদ্বোধন করতেন। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের বিস্তারিত তথ্য জানানো হতো। কিন্তু এবার বেলা ১১টায় নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অনলাইনে একযোগে প্রকাশিত হয়। তবে সাংবাদিকেরা ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে গেলে বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার সাংবাদিকদের কাছে ফলাফলের তথ্য তুলে ধরেন। তপন কুমার সরকার সব কটি বোর্ডের চেয়ারম্যানদের সংগঠন আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটিরও সভাপতি।
এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১১ লাখ ৩১ হাজার ১১৮ জন পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে পাস করেছেন ৮ লাখ ৫৪ হাজার ৬৪৪ জন। গড় পাসের হার ৭৫ দশমিক ৫৬। গতবার গড় পাসের হার ছিল ৭৬ দশমিক ৯। এবার ৯টি শিক্ষা বোর্ডের এইচএসসিতে জিপিএ–৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৩৭৬ জন, যা গতবার ছিল ৭৮ হাজার ৫২১ জন।
এবার পাসের হার কমে যাওয়া ও জিপিএ-৫ বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ বললেন অধ্যাপক তপন কুমার সরকার। তিনি বলেন, যে বিষয়গুলোর পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছিল, সেগুলোর ফলাফল উচ্চমাধ্যমিকে গড় পাসের হারে বড় রকমের প্রভাব পড়ে না। উচ্চমাধ্যমিক পাসের হারটি মূলত নির্ভর করে ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ের ওপর। কিন্তু এবার এই দুটি বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছিল। ফলে গড় পাসের হারটি স্বাভাবিক সময়ের মতো হয়েছে।
জিপিএ-৫ বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম প্রভাব হিসেবে বিষয় ম্যাপিং কাজ করেছে বলে মনে করেন তপন কুমার সরকার। তিনি বলেন, এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে যে শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন, তিনি হয়তো উচ্চমাধ্যমিকে মানবিকে পড়েছেন। ফলে এসএসসির বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর নম্বর এইচএসসিতে এসে মানবিকের বিষয়গুলোর বিপরীতে যোগ হয়েছে। এভাবে বিভাগ পরিবর্তনের কারণে জিপিএ-৫ বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
৯৩.৪০ শতাংশ পাস নিয়ে শীর্ষে মাদরাসা বোর্ড, পিছিয়ে ময়মনসিংহ বোর্ড : এবার ৯৩ দশমিক ৪০ শতাংশ পাসের হার নিয়ে ১১টি শিক্ষাবোর্ডের মধ্যে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে মাদরাসা বোর্ড। এর পরেই রয়েছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। ৮৮ দশমিক ০৯ শতাংশ পাসের হার নিয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে এ বোর্ড। এবার ৯ সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে সিলেট; আর জিপিএ-৫ প্রাপ্তির দিক থেকে প্রথমে রয়েছে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড। সিলেট শিক্ষা বোর্ডে এবার পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮৩ হাজার ১৬৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ পাস করেছে। উত্তীর্ণ ৭১ হাজার ১২ জনের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬ হাজার ৬৯৮ জন।
অন্যদিকে ঢাকা বোর্ডে উত্তীর্ণ ২ লাখ ৪৯ হাজার ২৭৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৮ হাজার ৫৪৮ জন। ঢাকা বোর্ডে এবার পাসের হার ৭৯ দশমিক ২১ শতাংশ।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডে ৯৩ দশমিক ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে; জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯ হাজার ৬১৩ জন। ১১টি শিক্ষা বোর্ডে এবার সবচেয়ে পিছিয়ে ময়মনসিংহ বোর্ড। এ বোর্ডে পাসের হার ৬৩ দশমিক ২২ শতাংশ; জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৮২৬ জন।
কারিগরি বোর্ডে এবারের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১ লাখ ১৪ হাজার ৩৮২ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৮৮ দশমিক ০৯ শতাংশ পাস করেছে; জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৯২২ জন।
রাজশাহী বোর্ডে ৮১ দশমিক ২৪ শতাংশ পাসের হার নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ৪৪৮ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৪ হাজার ৯০২ জন।
চট্টগ্রাম বোর্ডে ৭০ দশমিক ৩২ শতাংশ পাসের হার নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে ৭৪ হাজার ১২৫ জন। ১ লাখ ৫ হাজার ৪১৬ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ১০ হাজার ২৬৯ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে।
বরিশাল বোর্ডে এবার পাসের হার ৮১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। উত্তীর্ণ ৫৪ হাজার ৮৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ১৬৭ জন।
দিনাজপুর বোর্ডে ৮৬ হাজার ৯৫৪ জন শিক্ষার্থী পাস করেছে। তাদের মধ্যে ১৪ হাজার ২৯৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। পাসের হার ৭৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
কুমিল্লা বোর্ডে এবার পাসের হার ৭১ দশমিক ১৫ শতাংশ। এই বোর্ডের উত্তীর্ণ ৭৯ হাজার ৯০৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৭ হাজার ৯২২ জন।
আর যশোর বোর্ডে পাস করেছে ৬৮ দশমিক ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী। এই বোর্ডের উত্তীর্ণ ৭৮ হাজার ৭৬৪ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯ হাজার ৯৪৯জন।
৮০ দশমিক ৬৫ শতাংশ পাসের হারে গত বছর ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে সবার শীর্ষে ছিল বরিশাল। সম্মিলিত ১১ বোর্ডের হিসাবে পাসের হারে শীর্ষে ছিল কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। এই বোর্ডে ৯১ দশমিক ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী পাস করে গত বছর। আর জিপিএ-৫ এ সবার সেরা ঢাকা বোর্ডে পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পায় ৩১ হাজার ৭৫২ জন শিক্ষার্থী।
জিপিএ ৫ ও পাসে মেয়েরাই এগিয়ে : গত কয়েক বছরের মতো এবারও পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তিতে এগিয়ে আছে ছাত্রীরা।২০২৪ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১৩ লাখ ৩১ হাজার ৫৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ৬ লাখ ৬৫ হাজার ৪৫ জন। তাদের মধ্যে ৫ লাখ ৩১ হাজার ৭১৪ জন বা ৭৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ পাস করেছে। আর ৬ লাখ ৬৬ হাজার ১৩ জন ছাত্রের মধ্যে পাস করেছে ৫ লাখ ৩ হাজার ৫৯৫ জন, যার হার ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ।
চলতি বছর ছাত্রীদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৮০ হাজার ৯৩৩ জন; আর ছাত্রদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা ৬৪ হাজার ৯৭৮। তার মানে, ছাত্রদের চাইতে ১৫ হাজার ৯৫৫ জন বেশি ছাত্রী পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পেয়েছেন। এর আগে ২০২৩ সালের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় ছাত্রীদের মধ্যে ৪৯ হাজার ৩৬৫ জন জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন। আর পূর্ণাঙ্গ জিপিএ পাওয়া ছাত্রের সংখ্যা ছিল ৪৩ হাজার ২৩০। সেবার ছাত্রদের চাইতে ৬ হাজার ১৩৫ জন জন বেশি ছাত্রী জিপিএ ৫ পেয়েছিলেন।
৬৫ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি : এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় দেশের ৬৫ প্রতিষ্ঠানে কেউ পাস করেনি। আর শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করেছে ১ হাজার ৩৮৮টি প্রতিষ্ঠানে। গতকাল মঙ্গলবার ২০২৪ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। সকাল ১১টায় একযোগে ফল প্রকাশিত হয়। ঢাকা শিক্ষা বোর্ড মিলনায়তনে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটি সভাপতি অধ্যাপক তপন কুমার সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করেন।
অধ্যাপক তপন কুমার সরকার বলেন, ‘এবারের পরীক্ষায় ৬৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও শিক্ষার্থী পাস করেনি। আর শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করেছে ১ হাজার ৩৮৮ প্রতিষ্ঠান থেকে। ২০২৩ সালে শূন্য পাস প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৪০টি, এবার বেড়েছে। তবে গত বছর আমরা চারটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও শিক্ষার্থী পাস করবে না, তাদের বিরুদ্ধে এবারও ব্যবস্থা নেবো।’
কেউ পাস না করা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে অধ্যাপক স্থাপন কুমার সরকার বলেন, ‘যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করে না, এমন প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার্থী থাকে কম দুই-একজন। এসব প্রতিষ্ঠান নন-এমপিও।’


























