০৫:০৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘শুভ জন্মদিন’, বৈষম্যমুক্ত হোক সাংবাদিকদের ‘বাতিঘর’

শুভ জন্মদিন। অবিরাম শুভ কামনা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ৭০তম জন্মদিন আজ। ঐতিহাসিক পটভূমিতে সাংবাদিকদের ‘বাতিঘর’ খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। ১৯৫৪ সাল থেকে পথচলা শুরু প্রতিষ্ঠানটির। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ২০২৪ সালে এসে সাত দশক পূর্ণ করে একাত্তরে পা দেবে গৌরবময় প্রতিষ্ঠানটি। বৈষম্যমুক্ত, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, নিপীড়ন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন, যাবতীয় অধিকার আদায়ে সভা-সমাবেশের কেন্দ্রস্থল রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জাতীয় প্রেস ক্লাব। প্রতিষ্ঠাকালে এর নাম ছিল ‘ঢাকা প্রেস ক্লাব’। এখন ‘জাতীয় প্রেস ক্লাব’ হিসেবে বিশ্বদরবারে সুপরিচিত। প্রেস ক্লাবের সদস্য সাংবাদিকরা নিজেদের ‘সেকেন্ড হোম’ বা ‘দ্বিতীয় গৃহ’ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। ১৮, তোপখানা রোডের ঠিকানায় সাংবাদিকদের পেশা ও অস্তিত্ব অবিচ্ছিন্ন এক সত্তায় মিশে আছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশার উৎকর্ষ সাধন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার সুদীর্ঘ লড়াইয়ের উৎসভূমি আমাদের জাতীয় প্রেস ক্লাব। শুধু সাংবাদিকতা নয়, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ জাতীয় ইতিহাসের প্রতিটি সংকটময় পরিস্থিতিতে রয়েছে এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। স্বৈরাচারবিরোধী সব আন্দোলন, নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের তীর্থস্থান বললেও ভুল হবে না। আজ অক্টোবরের ২০ তারিখে ক্লাবটির শুভ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের জন্য ক্লাবের সদস্যগণ আনন্দে উৎবেলিত। অনুষ্ঠানে তাদের সেই আনন্দ আরও বাড়িয়ে তুলবেন জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে বৈষম্যমুক্ত ব্যবস্থা চালুর অগ্রনায়ক বিশ্বনন্দিত নোবেল বিজয়ী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যদিও জাতীয় প্রেস ক্লাবের জমকালো এই আনন্দঘন উৎসব দেখা বা উপভোগ করার সুযোগ নেই ক্লাবভুক্ত সদস্যদের বাইরের বৃহৎ সাংবাদিক অংশের।
বর্তমানে সারা দেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা (জুন/২০২৩ পর্যন্ত) ৩২২৭টি। ঢাকাতে ৫৩০টি দৈনিক পত্রিকা রয়েছে। আছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। ওই সব প্রতিষ্ঠানের কতজন সাংবাদিক জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই জন্মোৎসবের খবরই বা রাখেন বা জানেন? বৈষম্যের দেয়ালে বিভাজিত করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য সংখ্যা যে খুবই সীমিত; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ, নির্ধারিত মূল্যে ফরম বিক্রি করা হয়, যথাযথভাবে জমাও দেয়া হয়, সদস্য হওয়া ঝুলে থাকে বছরের পর বছর সেই অদৃশ্য খেলায়। একটি কমন প্রশ্ন, একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক হওয়া যত সহজ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য হওয়া যেন তার চেয়ে বেশি কঠিন বা অসম্ভব! এই বৈষম্য কেন? জাতীয় একটি প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত নিয়মকানুনের মধ্যে যেখানে সহজেই সবার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে। একে অন্যের সঙ্গে পেশাদারিত্বের বাইরে প্রাণখুলে মন উজাড় করে আড্ডা দেবেন সেই ক্লাবে, তা নয় কেন? দেশে সংবাদপত্রের সংখ্যা বাড়াতে সমস্যা নেই, সাংবাদিক হওয়াতে সমস্যা নেই, সাংবাদিকদের ‘বাতিঘর’ সেই জাতীয় প্রেস ক্লাবের মেম্বারশিপ পেতে এতো জটিলতা কেন? নতুন বাংলাদেশের পথযাত্রায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই বৈষম্য দূর হোক। জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আরও নতুন সদস্য হওয়ার পথ উন্মুক্ত হোক এটি সময়ের জোর দাবি। সেই সঙ্গে ঐতিহ্যের ধারা, আনন্দের উদ্ভাস ও গৌরবের বর্ণচ্ছটায় ক্লাবের আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনটি সদস্যদের প্রাণে-মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে আনুক।
একটা সময়, প্রেস ক্লাব শুধু সাংবাদিকদেরই নয়, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ক্রীড়াঙ্গনের তারকাখ্যাতির মানুষদের মিলনকেন্দ্র ছিল। মহিরুহ সম্পাদক ও পথিকৃৎ সাংবাদিকরা দিবারাত্রির বেশিরভাগ সময় আড্ডা-আলোচনায় মুখর রাখতেন তাদের দ্বিতীয় ঘরটি। বিগত ১৫ বছরে তার চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই ধারা এখনো কাটেনি। সম্প্রতি নতুন সদস্য পদ দেয়া নিয়েও নানা গুঞ্জন শোনা যায়। এমন কী জাতীয় পত্রিকায় পর্যন্ত সদস্য পদ বাণিজ্য সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে; যা আমাদের বিস্মিত করে। অবাক হই।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে জনাব এম আবদুল্লাহ লিখেছেন তার কিছু অংশ তুলে ধরলাম- একসময় পুলিশের মার খেয়ে রাজনৈতিক নেতারা প্রেস ক্লাবে আশ্রয় নিলে নিরাপদ হয়ে যেতেন। ক্লাবের ভেতরে পুলিশ ঢুকে কাউকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে, তা ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে ন্যক্কারজনকভাবে জাতীয় নেতাদের প্রেস ক্লাব থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৫ সালে রাষ্ট্রক্ষমতার জোরে অবৈধভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবটি দখলের পর এর মানমর্যাদা ও ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত হয়। ক্লাবকে ফ্যাসিবাদী শাসনের সহায়ক শক্তির আখড়ায় পরিণত করা হয়। ক্লাবের চেয়ার ব্যবহার করে অঢেল বিত্তবৈভব গড়া ও রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তপনায় শামিল হওয়ার দুঃখজনক চিত্র দেখা গেছে। নতুন বাংলাদেশে সাংবাদিক সমাজের এ অহংকারের প্রতিষ্ঠানটি তার হৃতগৌরব কতটুকু পুনরুদ্ধার করে স্বমহিমায় কতটা ফিরতে পারে, তা দেখার বিষয়। যদিও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ করলাম, সম্প্রতি নতুন সদস্যপদ দেওয়া নিয়েও নানা কেলেঙ্কারিতে ক্লাবের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হয়েছে। ১৯৫৫ সালের ১৯ জুন তৎকালীন ঢাকা প্রেস ক্লাবের প্রথম অনুষ্ঠান হয়। প্রেস ক্লাবের একটি গর্বের জায়গা ছিল যে, কোনো স্বৈরশাসক ও একনায়ককে এখানে আসতে দেওয়া হতো না। প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর সিদ্ধান্ত হয়, আইয়ুব খানের গভর্নর মোনায়েম খানকে প্রেস ক্লাবে আসতে দেওয়া হবে না। ছয় বছর গভর্নর থাকাকালে অনেক চেষ্টা, চাপ ও প্রলোভন দেখিয়েও মোনায়েম খান প্রেস ক্লাবের আমন্ত্রণ আদায় করতে পারেননি। কখনো আসতে পারেননি। একইভাবে নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসক এরশাদের বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত ছিল। সেই সিদ্ধান্তও কঠোরভাবে কার্যকর করে এরশাদকে কখনো জাতীয় প্রেস ক্লাবে আসতে দেওয়া হয়নি। বরং এরশাদের পতন লেখা হয়েছিল এই প্রেস ক্লাবে অবস্থিত সাংবাদিক ইউনিয়নের অফিসে বসে।
শ্রদ্ধেয় সিনিয়র সাংবাদিক এম আবদুল্লাহ লিখেন- আমাদের অগ্রজ সাংবাদিকরা জাতীয় প্রেস ক্লাবকে কীভাবে নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার করে নিয়েছিলেন, তা তাদের বিভিন্ন স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে। প্রেস ক্লাবের চারবারের সভাপতি ও তিনবারের সম্পাদক এবিএম মূসা এক স্মৃতিচারণে লিখেন- ‘আমরা ছোটরা তখন কী করতাম? ভাবতে অবাক লাগছে। নিজেদের তখন বয়সে ও পেশার জীবনে কত কনিষ্ঠ ভাবতাম। চুপচাপ দোতলায় উঠে যেতাম, সেখানে তাস খেলতাম অথবা পেছনের উঠানে আমগাছের নিচে কাঠের চেয়ারে বসে গুলতানি মারতাম। শতাব্দীপ্রাচীন সেই আমগাছগুলো, বিশেষ করে একটি পেয়ারাগাছের জন্য এখনো মায়া জাগে। আমাদের মধ্যেও তর্ক-বিতর্ক হতো নানা ধরনের।’ প্রেস ক্লাব ক্যান্টিনে খাবার নিয়ে এবিএম মূসা লিখেন ‘চা খাওয়া হতো দেদার। প্রথম থেকেই ক্লাবের ক্যান্টিনটি চালু করেছিলেন অবাঙ্গালি পিটিআই প্রতিনিধি বালান সাহেব। এক আনায়, মানে ছয় পয়সায় চা, বাটার টোস্ট একখানা। তখনই চালু হয়েছিল প্রেস ক্লাবের ঐতিহ্যবাহী আণ্ডাপুরি। ঢাকায় তখন এই খাবারটির নতুনত্ব এতই প্রচার লাভ করেছিল, বাইরের বন্ধু-বান্ধবরা আবদার করতেন- দোস্ত তোদের ক্লাবের আণ্ডাপুরি খাওয়াবি? দুপুরে ভাত, ডাল, মাছ সঙ্গে ভাজি। দিতে হতো আট আনা। পঞ্চাশ পয়সায় পেটপুরে খাওয়া। রোববারে ফিস্ট, বিশেষ খাওয়া। সবাই আসতাম সপরিবারে, মানে যাদের পরিবার ছিল। বিশেষ খাওয়া পোলাও, মুরগি, ডিম এবং পডিং। মূল্য ১ টাকা ২৫ পয়সা মাত্র। মজার ব্যাপার, এখনও এবং তখনও প্রেস ক্লাবে যাওয়া মানেই খাওয়া আর অবসরের আড্ডা।’
গুণী সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ লিখেন- ‘এককালে প্রেস ক্লাব আমার মাতৃসম ছিল। ছুটি থাক বা না থাক, প্রেস ক্লাবে গিয়ে আড্ডা বা তাস না খেললে আমার সে দিনটা বৃথা যেত। বেশিরভাগ সময় সকালে নাস্তা না খেয়ে এক কাপ চায়ের পর সোজা প্রেস ক্লাব। এখানে এসে লুচি-তরকারি-ডিম আর চা না খাওয়া পর্যন্ত যেন স্বস্তি নেই। পৃথিবীতে এমন নাস্তা যেন আর কোথাও নেই।’
পরিশেষে বলতে চাই, জাতীয় প্রেস ক্লাব নিয়ে প্রখ্যাত দু’জন সাংবাদিকের এমন মধুর স্মৃতি জানার পর এই প্রতিষ্ঠানে প্রকৃত সাংবাদিকরা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা রাখবেন এই অভিলাস থাকাটা স্বাভাবিক। শুভ হোক, সার্থক হোক জাতীয় প্রেস ক্লাবের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আবারও শুভ জন্মদিন জাতীয় প্রেস ক্লাব।
লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক সবুজ বাংলা।

জনপ্রিয় সংবাদ

লালমনিরহাটে ৬ ঘণ্টা পর স্বাভাবিক হলো ট্রেন চলাচল

‘শুভ জন্মদিন’, বৈষম্যমুক্ত হোক সাংবাদিকদের ‘বাতিঘর’

আপডেট সময় : ০৮:২১:৩২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২০ অক্টোবর ২০২৪

শুভ জন্মদিন। অবিরাম শুভ কামনা। জাতীয় প্রেস ক্লাবের ৭০তম জন্মদিন আজ। ঐতিহাসিক পটভূমিতে সাংবাদিকদের ‘বাতিঘর’ খ্যাত এই প্রতিষ্ঠানের জন্ম। ১৯৫৪ সাল থেকে পথচলা শুরু প্রতিষ্ঠানটির। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে ২০২৪ সালে এসে সাত দশক পূর্ণ করে একাত্তরে পা দেবে গৌরবময় প্রতিষ্ঠানটি। বৈষম্যমুক্ত, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো, নিপীড়ন ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন, যাবতীয় অধিকার আদায়ে সভা-সমাবেশের কেন্দ্রস্থল রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত জাতীয় প্রেস ক্লাব। প্রতিষ্ঠাকালে এর নাম ছিল ‘ঢাকা প্রেস ক্লাব’। এখন ‘জাতীয় প্রেস ক্লাব’ হিসেবে বিশ্বদরবারে সুপরিচিত। প্রেস ক্লাবের সদস্য সাংবাদিকরা নিজেদের ‘সেকেন্ড হোম’ বা ‘দ্বিতীয় গৃহ’ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। ১৮, তোপখানা রোডের ঠিকানায় সাংবাদিকদের পেশা ও অস্তিত্ব অবিচ্ছিন্ন এক সত্তায় মিশে আছে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশার উৎকর্ষ সাধন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার সুদীর্ঘ লড়াইয়ের উৎসভূমি আমাদের জাতীয় প্রেস ক্লাব। শুধু সাংবাদিকতা নয়, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাসহ জাতীয় ইতিহাসের প্রতিটি সংকটময় পরিস্থিতিতে রয়েছে এর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। স্বৈরাচারবিরোধী সব আন্দোলন, নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের তীর্থস্থান বললেও ভুল হবে না। আজ অক্টোবরের ২০ তারিখে ক্লাবটির শুভ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপনের জন্য ক্লাবের সদস্যগণ আনন্দে উৎবেলিত। অনুষ্ঠানে তাদের সেই আনন্দ আরও বাড়িয়ে তুলবেন জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার গণভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে বৈষম্যমুক্ত ব্যবস্থা চালুর অগ্রনায়ক বিশ্বনন্দিত নোবেল বিজয়ী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। যদিও জাতীয় প্রেস ক্লাবের জমকালো এই আনন্দঘন উৎসব দেখা বা উপভোগ করার সুযোগ নেই ক্লাবভুক্ত সদস্যদের বাইরের বৃহৎ সাংবাদিক অংশের।
বর্তমানে সারা দেশে পত্র-পত্রিকার সংখ্যা (জুন/২০২৩ পর্যন্ত) ৩২২৭টি। ঢাকাতে ৫৩০টি দৈনিক পত্রিকা রয়েছে। আছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং সরকারি ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। ওই সব প্রতিষ্ঠানের কতজন সাংবাদিক জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই জন্মোৎসবের খবরই বা রাখেন বা জানেন? বৈষম্যের দেয়ালে বিভাজিত করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য সংখ্যা যে খুবই সীমিত; তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ, নির্ধারিত মূল্যে ফরম বিক্রি করা হয়, যথাযথভাবে জমাও দেয়া হয়, সদস্য হওয়া ঝুলে থাকে বছরের পর বছর সেই অদৃশ্য খেলায়। একটি কমন প্রশ্ন, একটি সংবাদপত্রের সম্পাদক হওয়া যত সহজ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্য হওয়া যেন তার চেয়ে বেশি কঠিন বা অসম্ভব! এই বৈষম্য কেন? জাতীয় একটি প্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত নিয়মকানুনের মধ্যে যেখানে সহজেই সবার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকবে। একে অন্যের সঙ্গে পেশাদারিত্বের বাইরে প্রাণখুলে মন উজাড় করে আড্ডা দেবেন সেই ক্লাবে, তা নয় কেন? দেশে সংবাদপত্রের সংখ্যা বাড়াতে সমস্যা নেই, সাংবাদিক হওয়াতে সমস্যা নেই, সাংবাদিকদের ‘বাতিঘর’ সেই জাতীয় প্রেস ক্লাবের মেম্বারশিপ পেতে এতো জটিলতা কেন? নতুন বাংলাদেশের পথযাত্রায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের এই বৈষম্য দূর হোক। জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আরও নতুন সদস্য হওয়ার পথ উন্মুক্ত হোক এটি সময়ের জোর দাবি। সেই সঙ্গে ঐতিহ্যের ধারা, আনন্দের উদ্ভাস ও গৌরবের বর্ণচ্ছটায় ক্লাবের আজকের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজনটি সদস্যদের প্রাণে-মনে আনন্দের হিল্লোল বয়ে আনুক।
একটা সময়, প্রেস ক্লাব শুধু সাংবাদিকদেরই নয়, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ক্রীড়াঙ্গনের তারকাখ্যাতির মানুষদের মিলনকেন্দ্র ছিল। মহিরুহ সম্পাদক ও পথিকৃৎ সাংবাদিকরা দিবারাত্রির বেশিরভাগ সময় আড্ডা-আলোচনায় মুখর রাখতেন তাদের দ্বিতীয় ঘরটি। বিগত ১৫ বছরে তার চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেই ধারা এখনো কাটেনি। সম্প্রতি নতুন সদস্য পদ দেয়া নিয়েও নানা গুঞ্জন শোনা যায়। এমন কী জাতীয় পত্রিকায় পর্যন্ত সদস্য পদ বাণিজ্য সংক্রান্ত খবর প্রকাশিত হয়েছে; যা আমাদের বিস্মিত করে। অবাক হই।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সভাপতি, বিএফইউজে জনাব এম আবদুল্লাহ লিখেছেন তার কিছু অংশ তুলে ধরলাম- একসময় পুলিশের মার খেয়ে রাজনৈতিক নেতারা প্রেস ক্লাবে আশ্রয় নিলে নিরাপদ হয়ে যেতেন। ক্লাবের ভেতরে পুলিশ ঢুকে কাউকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে, তা ছিল কল্পনাতীত। কিন্তু সাম্প্রতিক অতীতে ন্যক্কারজনকভাবে জাতীয় নেতাদের প্রেস ক্লাব থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৫ সালে রাষ্ট্রক্ষমতার জোরে অবৈধভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবটি দখলের পর এর মানমর্যাদা ও ঐতিহ্য ভূলুণ্ঠিত হয়। ক্লাবকে ফ্যাসিবাদী শাসনের সহায়ক শক্তির আখড়ায় পরিণত করা হয়। ক্লাবের চেয়ার ব্যবহার করে অঢেল বিত্তবৈভব গড়া ও রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তপনায় শামিল হওয়ার দুঃখজনক চিত্র দেখা গেছে। নতুন বাংলাদেশে সাংবাদিক সমাজের এ অহংকারের প্রতিষ্ঠানটি তার হৃতগৌরব কতটুকু পুনরুদ্ধার করে স্বমহিমায় কতটা ফিরতে পারে, তা দেখার বিষয়। যদিও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ করলাম, সম্প্রতি নতুন সদস্যপদ দেওয়া নিয়েও নানা কেলেঙ্কারিতে ক্লাবের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হয়েছে। ১৯৫৫ সালের ১৯ জুন তৎকালীন ঢাকা প্রেস ক্লাবের প্রথম অনুষ্ঠান হয়। প্রেস ক্লাবের একটি গর্বের জায়গা ছিল যে, কোনো স্বৈরশাসক ও একনায়ককে এখানে আসতে দেওয়া হতো না। প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার পর সিদ্ধান্ত হয়, আইয়ুব খানের গভর্নর মোনায়েম খানকে প্রেস ক্লাবে আসতে দেওয়া হবে না। ছয় বছর গভর্নর থাকাকালে অনেক চেষ্টা, চাপ ও প্রলোভন দেখিয়েও মোনায়েম খান প্রেস ক্লাবের আমন্ত্রণ আদায় করতে পারেননি। কখনো আসতে পারেননি। একইভাবে নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসক এরশাদের বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত ছিল। সেই সিদ্ধান্তও কঠোরভাবে কার্যকর করে এরশাদকে কখনো জাতীয় প্রেস ক্লাবে আসতে দেওয়া হয়নি। বরং এরশাদের পতন লেখা হয়েছিল এই প্রেস ক্লাবে অবস্থিত সাংবাদিক ইউনিয়নের অফিসে বসে।
শ্রদ্ধেয় সিনিয়র সাংবাদিক এম আবদুল্লাহ লিখেন- আমাদের অগ্রজ সাংবাদিকরা জাতীয় প্রেস ক্লাবকে কীভাবে নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার করে নিয়েছিলেন, তা তাদের বিভিন্ন স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে। প্রেস ক্লাবের চারবারের সভাপতি ও তিনবারের সম্পাদক এবিএম মূসা এক স্মৃতিচারণে লিখেন- ‘আমরা ছোটরা তখন কী করতাম? ভাবতে অবাক লাগছে। নিজেদের তখন বয়সে ও পেশার জীবনে কত কনিষ্ঠ ভাবতাম। চুপচাপ দোতলায় উঠে যেতাম, সেখানে তাস খেলতাম অথবা পেছনের উঠানে আমগাছের নিচে কাঠের চেয়ারে বসে গুলতানি মারতাম। শতাব্দীপ্রাচীন সেই আমগাছগুলো, বিশেষ করে একটি পেয়ারাগাছের জন্য এখনো মায়া জাগে। আমাদের মধ্যেও তর্ক-বিতর্ক হতো নানা ধরনের।’ প্রেস ক্লাব ক্যান্টিনে খাবার নিয়ে এবিএম মূসা লিখেন ‘চা খাওয়া হতো দেদার। প্রথম থেকেই ক্লাবের ক্যান্টিনটি চালু করেছিলেন অবাঙ্গালি পিটিআই প্রতিনিধি বালান সাহেব। এক আনায়, মানে ছয় পয়সায় চা, বাটার টোস্ট একখানা। তখনই চালু হয়েছিল প্রেস ক্লাবের ঐতিহ্যবাহী আণ্ডাপুরি। ঢাকায় তখন এই খাবারটির নতুনত্ব এতই প্রচার লাভ করেছিল, বাইরের বন্ধু-বান্ধবরা আবদার করতেন- দোস্ত তোদের ক্লাবের আণ্ডাপুরি খাওয়াবি? দুপুরে ভাত, ডাল, মাছ সঙ্গে ভাজি। দিতে হতো আট আনা। পঞ্চাশ পয়সায় পেটপুরে খাওয়া। রোববারে ফিস্ট, বিশেষ খাওয়া। সবাই আসতাম সপরিবারে, মানে যাদের পরিবার ছিল। বিশেষ খাওয়া পোলাও, মুরগি, ডিম এবং পডিং। মূল্য ১ টাকা ২৫ পয়সা মাত্র। মজার ব্যাপার, এখনও এবং তখনও প্রেস ক্লাবে যাওয়া মানেই খাওয়া আর অবসরের আড্ডা।’
গুণী সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ লিখেন- ‘এককালে প্রেস ক্লাব আমার মাতৃসম ছিল। ছুটি থাক বা না থাক, প্রেস ক্লাবে গিয়ে আড্ডা বা তাস না খেললে আমার সে দিনটা বৃথা যেত। বেশিরভাগ সময় সকালে নাস্তা না খেয়ে এক কাপ চায়ের পর সোজা প্রেস ক্লাব। এখানে এসে লুচি-তরকারি-ডিম আর চা না খাওয়া পর্যন্ত যেন স্বস্তি নেই। পৃথিবীতে এমন নাস্তা যেন আর কোথাও নেই।’
পরিশেষে বলতে চাই, জাতীয় প্রেস ক্লাব নিয়ে প্রখ্যাত দু’জন সাংবাদিকের এমন মধুর স্মৃতি জানার পর এই প্রতিষ্ঠানে প্রকৃত সাংবাদিকরা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রত্যাশা রাখবেন এই অভিলাস থাকাটা স্বাভাবিক। শুভ হোক, সার্থক হোক জাতীয় প্রেস ক্লাবের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আবারও শুভ জন্মদিন জাতীয় প্রেস ক্লাব।
লেখক : ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক সবুজ বাংলা।