শহুরে অবসাদ দূর করতে ঘুরে আসুন দামতুয়া ঝর্না শহরের যান্ত্রিক জাঁতাকলে আটকা মানুষের জীবন। ইটপাথরের নগরীতে সকালে অফিস, সন্ধ্যে হলে ফের সেই প্রকৃতিহীন পাথুরে নীড়! মায়াহীন এই আবহ থেকে একটু প্রশান্তির খোঁজ কে না চায়। পাহাড়চূড়ায় জম্পেশ আড্ডা কিংবা ঝরনার জলে ভিজতে কার না ভালো লাগে। দরকার শুধু ভালো কিছু সঙ্গ আর একটু সময়ের। তাই মনকে প্রশান্তি দিতে ঘুরে আসতে পারেন দামতুয়া ঝর্না বা ডামতুয়া ঝর্না থেকে। এটি বান্দরবান জেলার আলিকদম উপজেলায় অবস্থিত।
এখানে দু’দিক থেকে পানি পড়ার কারণে ঝর্নাসহ খোলা স্থানটিতে চাঁদের আলোতে অন্যরকম সৌন্দর্য বিরাজ করে, তাই স্থানীয় মুরং ভাষায় এটাকে ‘লামোনই’ ঝর্না বলা হয়। লামো অর্থ চাঁদ ও নই অর্থ আলো। লামোনই অর্থ চাঁদের আলো। আলিকদ থেকে চাঁদের গাড়িতে করে ১৭ কিলোমিটার দূরে আদুপাড়া পাশ দিয়ে ঝর্নার যাত্রাপথ। এখানে যাওয়ার পথে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তায় কয়েকটি ভিউ পয়েন্ট পাবেন, যেখানে কিছুক্ষণের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন অদৃশ্য মায়ার অজানা কোনো স্রোতে। সাধারণত সারাবছর এখানে মানুষের আনাগোনা থাকে। প্রতিবছর বিভিন্ন ছুটির দিনে পাহাড়প্রেমী শত শত পর্যটকের আগমন ঘটে এখানে। এখানকার প্রতিটি পরতে পরতে আছে প্রকৃতির অনাবিল প্রশান্তি। চারিদিক পাহাড় আর সবুজ মুগ্ধতায় ভরিয়ে রেখেছে। ঝরনাধারায় গা ভিজিয়ে মানুষ যান্ত্রিক জীবনের অবসাদ থেকে নিজেকে খানিকটা মুক্ত করতে পারবে।
নিজেদের একটু উজ্জীবিত করতে আমরা ১২ বন্ধু (আবদুল্লাহ্, মারুফ, তামিম, ফাহাদ, শফিক, আকাশ, মিশু, রাফি, হারুন, রাশেদ, তওহিদ, সাখাওয়াত) বেরিয়ে পড়লাম সেই গন্তব্যে। ভোরে উঠে অলিকদম বাজার থেকে সকালে খাওয়া-দাওয়া করলাম। এরপর নিজেদের প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে চাঁদের গাড়িতে করে রওনা দিলাম মূল গন্তব্যের দিকে। আকাঁবাকাঁ রাস্তায় গাড়ি চলছে, আমাদের মনে হচ্ছে যেন মেঘের মধ্য দিয়ে আমাদের গাড়ি ভেদ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে আপনি যখন ডিম পাহাড় পাড়ি দেবেন তখন এই অনুভবটা আরও বেশি হবে। মূল ঝর্নায় যাওয়ার আগে কয়েকটি ভিউ পয়েন্টে গাড়ি থামিয়ে নিজেরা কিছু সময় উপভোগ করলাম। যেহেতু আমরা ভোরেই রওনা দিয়েছিলাম, তাই তেমন কোন ঝামেলায় পড়তে হয়নি। অবশ্যই ওই দিকে যাওয়ার সময় সোনাবাহিনীর খাতায় অ্যান্ট্রি করে যাওয়া লাগবে। তাই আপনার ভ্রমণে জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্মনিবন্ধের ফটোকপি সাথে নেবেন। গাড়িতে গান আর আড্ডা দিতে দিতে কখন যে আমরা ১৭ কিলোমিটারে পৌঁছালাম টেরই পেলাম না। গাড়ি থেকে নেমে মূল ঝরনায় পৌঁছাতে পায়ে হেঁটে আনুমানিক ১০-১৫ কিলোমিটার যাওয়া লাগবে। সকলে নেমে সেই গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে দিলাম। কারও হাতে ছোট ছোট বাঁশ আবার কারও হাতে ছোট কাঠি। এটি নেওয়ার একমাত্র কারণ যাতে হাঁটার সময় একটু শক্তির সঞ্চার হয়।
পাহাড়ের পর পাহাড়, একটি পাড়ি দিয়ে আবার পাহাড়! আমাদের এই পাহাড়ার যাত্রার আনন্দটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল সাথে থাকা ছোট সাউন্ডবক্স। আমরা যখন একটু ক্লান্তি অনুভব করি তখন সবাই মিলে গান গেয়ে নাচানাচি করি। পাহাড়ি ঝিরিপথ দিয়ে হাঁটার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে সবচেয়ে বেশি অবস্থার সম্মুখীন হয় সাখাওয়াত। আর কোন ধরণের ক্লান্তির ছাপ ছাড়া অনবরত হেঁটে রেকর্ড করেছে রাশেদ,তারপর হচ্ছে মিশু। আবার সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে শফিক, রাফি । আমাদের সবাই যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি আবার উজ্জিবিত করে মারুফ আর তামিম। আর একটি বিষয় বলে রাখা ভালো এই যাত্রার আমাদের সুন্দর সময়গুলো ধারণ করেছে আকাশ আর সাখাওয়াত।
এই যাত্রায় পাহাড়ি মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে অনেক ধারণা হয়েছে। উঁচু পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট দু’চালা স্কুলে পড়াশোনা করছেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠি। অসাধারণ এই পাহাড় যাত্রায় সবকিছু ছিল আমাদের জন্য নতুন এবং আনন্দদায়ক। সেখানকার পাহাড়িদের জুম চাষ, তাদের জীবনযাপন সবকিছু মিলে পাহাড়ের যাত্রাটি অসাধারণ। যাত্রাপথের একটি মজার ঘটনা বলিÑ ‘পাহাড়ে একটি ছাগল বাচ্ছা প্রসব করল। মালিক পক্ষের কোন খোঁজখবর নেই। সবাই মিলে পাশে একটি বাড়ি আছে তাদেরকে ডাক দিলাম। পরে তারা এসে বাকি কাজ করল।’ দামতুয়া যাওয়ার পথে ছোট-বড় মিলে তিনটি ঝরনা দেখতে পারবেন। একটি ঝর্না থেকে আরেকটি ঝর্নার দূরত্ব ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। তবে মূল ঝর্নায় যাওয়ার জন্য একটি পাহাড় পাড়ি দিয়ে একটু ঝিরিপথ, আবার সেই পাহাড় সাথে আছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জুম চাষ। এই দৃশ্য দেখলে মন জুড়িয়ে যায় ভ্রমণ পিপাসু মানুষের। অবশ্যই যাওয়ার সময় আপনাদের সাথে শুকনো খাবার নিয়ে যেতে হবে। এখানে খাবারা পাওয়া যায় না। প্রায় ৩ ঘণ্টার পথ অতিক্রম করে যখন প্রধান ঝর্নার দৃশ্য দেখি, সবার ক্লান্তি নিমিষে দূর হয়ে যায়। দু’পাশ দিয়ে পড়া ঝর্নার পানিতে সবাই গোসল করলাম। আহা কী আনন্দ তা প্রকাশ করার মতো না। আমরা এতটা মজার সময় কাটিয়েছি যে, ভুলেই গিয়েছিলাম আমাদের আবার ফিরতে হবে। কিছুক্ষণ পরে আবার নিজেদের সেই আসল গন্তব্যে রওনা দিলাম। ফেরার সময় প্রায় সবার শক্তি কিছুটা কমে আসে, আমাদের সাথে যে শুকনো খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম তাও শেষ হয়ে যায়। তবে পথে কিছু কিছু স্থানে পাহাড়ি আদিবাসিদের চাষ করা ফল (কলা, শসা ইত্যাদি) পেয়েছিলাম, এগুলো খেয়ে আমরা আবার রওনা দিলাম। যেহেতু আমরা একদম সকাল সকাল রওনা দিয়েছিলাম, সে কারণে একটু সুবিধা হয়েছিল। আপনারাও যাওয়ার সময় পর্যাপ্ত শুকনো খাবার নিয়ে যাবেন। ভোরে রওয়ানা দেবার চেষ্টা করবেন। যাওয়ার সঠিক সময়: সাধারণত এই ঝরনায় সারাবছর যাওয়া যায়। প্রাকৃতিক ঝরনার যৌবন হলো বর্ষাকালে। এই সময়ে প্রচণ্ড গতিতে জলধারা গড়িয়ে পড়ে। শীতে সেটা তেমন নয়। বর্ষাকালেই ঝরনা প্রাণ ফিরে পায়। তাই বর্ষাকালেই ঝরনা দেখা শ্রেয়। তবে পাহাড়ধসের সতর্কতা মনে রাখতে হবে। ভারী বর্ষণ হলে ঝিরিপথে পানির স্রোত বেশি থাকে। এতে করে যাওয়া অসম্ভব ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে যাবার পথ অনেক কঠিন হয়ে যায়।
যাওয়ার উপায়: দামতুয়া ঝরনা যেতে হলে আপনাকে প্রথম আলীকদম-থানচি সড়কের ১৭ কিলোমিটার পয়েন্টের জায়গায় আসতে হবে। আগে শুধুমাত্র একভাবে যাওয়া যেত, এখন আপনি ১৯ কিলোমিটার দিয়ে যেতে পারবেন। যদি ১৯ কিলো দিয়ে রওনা দেন তাহলে কম হাঁটা লাগবে। এখানে আসা যায় দুইভাবে। কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা থেকে আলীকদম হয়ে অথবা সরাসরি আলীকদম গিয়ে। আরেকটি পথ হলো, বান্দরবান শহর থেকে আলীকদম যাবার রোড ধরে। সবচেয়ে সহজ হচ্ছে চকরিয়া থেকে আলীকদম হয়ে যাওয়া। আপনারা একসাথে বেশি মানুষ থাকলে আলীকদম থেকে চান্দের গাড়ী/জীপ ভাড়া করে নিতে পারবেন। আলীকদম থেকে যাবার পথে ১০ কিলোমিটার যাবার পর আর্মি ক্যাম্প আছে। সেখানে সবার ন্যাশনাল আইডি কার্ড ও ফোন নাম্বার দিয়ে নাম এন্ট্রি করে সামনে যাবার জন্যে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, আপনাকে অবশ্যই সেইদিনই ট্্রাকিং শেষ করে বিকেল ৫টার আগে এই ১০ কিলো আর্মি ক্যাম্পে ফিরে এসে রিপোর্ট করতে হবে। তাই সময়ের দিকে খেয়াল রাখা উচিৎ।
যেসব সুবিধা পাবেন: আপনাদের সময় এবং সবকিছু বিবেচনা করে সঙ্গে একজন ট্যুর গাইড হিসেবে স্থানীয় কাউকে নিয়ে গেলে সুবিধা হয়। আলীকদম এলাকা থেকে স্থানীয় প্রশাসনের আওতায় রেজিস্ট্রেশনকৃত গাইড নিয়ে যাবেন। এলাকায় পর্যটকদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য অনেক চাকমা ছেলে আছে। সকাল ৯টা-১০টার মধ্যে হাঁটা শুরু করলে সুবিধা হয়। এ সময় রওনা দিলে ভালো করে সবক’টি ঝরনা দেখে বিকেলের মধ্যে ফিরে আসা যাবে। প্রয়োজনীয় ও চাহিদামতো খাবার, প্রাথমিক চিকিৎসা-উপকরণ, পানি, লাঠি, ছুরি, কাপড় ও জুতো ইত্যাদি নিলে সুবিধা হবে। কারণ, ওখানে দোকান নেই।
থাকা ও খাওয়া দাওয়া: একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, আর্মি ক্যাম্প থেকে দামতুয়া যাবার পথে থাকতে দেয় না। আপনাকে দামতুয়া ঝরনা দেখে সেদিনই আলীকদম ফিরে আসতে হবে। আর আলীকদম থাকার মত তেমন ভালো কোন হোটেল বা আবাসিক ব্যবস্থা নেই। যদি একান্ত থাকার প্রয়োজন হয় তাহলে জেলা প্রশাসনের বাংলোতে থাকতে পারবেন। তবে তাদের সাথে আগে থেকে যোগাযোগ করে যাওয়া ভালো। ঢাকা থেকে গেলে সকালে পৌঁছে সারাদিন ঘুরে আলীকদম থেকে সন্ধ্যার ফিরতি বাসে ঢাকা চলে আসতে পারবেন। খাওয়ার জন্য আলীকদমে বা আলীকদমের পানবাজারে মোটামুটি মানের বেশকিছু হোটেল আছে। সেখানে দেশীয় খাবারের ব্যবস্থা আছে, অল্প খরচে খেয়ে নিতে পারবেন।
সর্তকর্তা : ঝরনায় যাওয়ার রাস্তা বেশ দুর্গম এবং পাথরের জায়গা পিচ্ছিল থাকতে পারে। তাই সতর্কতার সঙ্গে পথ চলতে হবে। মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ওই দুর্গম রাস্তা পাড়ি দিয়ে ফিরে আসা অনেক কঠিন হবে। তাই ট্র্যাকিংসহায়ক জুতো নিতে ভুলবেন না। তবে অবশ্যই পরিবেশ নোংরা করবেন না। সঙ্গে নেওয়া চিপস, পানির বোতল ইত্যাদি ফেলে আসবেন না।


























