# এবছর আক্রান্ত লক্ষাধিক, মৃত্যু ৫৬১
# বর্ষা মৌসুম দেরিতে শুরু হওয়ায় ডিসেম্বরেও ভয়াবহতা
# গতানুগতিক পদ্ধতিতেই আটকা সিটি করপোরেশন
# কাউন্সিলরবিহীন সিটি করপোরেশনে তদারকিরও কেউ নেই
প্রতি বছরই বর্ষার মৌসুম এলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতায় নাকানিচুবানি খায় রাজধানীবাসী। লক্ষাধিক আক্রান্তের সঙ্গে প্রাণহানির সংখ্যাও কম নয়। বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে তা সামাল দিতে গিয়েও হিমশিম অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় সরকার এবং দুই সিটি করপোরেশনকে। তবে এবার যেন এর ভয়াবহতা আরও বেশি। দুই সিটি করপোরেশনের ডেঙ্গু প্রতিরোধে গতানুগতিক সিদ্ধান্ত আর নির্লিপ্ততায় এবার ডিসেম্বরে এসেও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমেনি। এবার বর্ষা মৌসুম দেরিতে শুরু হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ এই ডিসেম্বরে এসেও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিগত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে ডেঙ্গুতে অনেক প্রাণ গেলেও এর ভয়াবহতা রুখতে পারেনি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এর ওপর এ বছর ঢাকার দুই সিটিতে কোনো মেয়র ও কাউন্সিলর না থাকায় সিটি করপোরেশন পরিচালনায় প্রশাসক নিয়োগ দিলেও মাঝে অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়ে কার্যক্রম। মশক নিধনসহ ডেঙ্গু মোকাবিলার কাজে ভাটা পড়ায় বর্তমানে পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে উঠেছে। ডিসেম্বরে এসে আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে এবং মৃত্যুর সংখ্যাও ছাড়িয়েছে ৫৬১। এমন পরিস্থিতিতে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত শনিবার পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। তবে তাঁদের মধ্যে ৯৮ হাজারের বেশি মানুষ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। মারা গেছেন ৫৬১ জন। শনিবার সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৪১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে চলতি বছর ১ লাখ ২৯ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এঁদের মধ্যে চলতি মাসে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮ হাজার ৫৬০ জন। এখন পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন ৯৮ হাজার ২৬৯ জন। এ নিয়ে ডিসেম্বরের ২১ দিনে ডেঙ্গুতে ৭৩ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের পর থেকে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র, প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলররা অফিস করছেন না। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দুই সিটি করপোরেশনের সব কাউন্সিলরকে অপসারণ করা হয়। ফলে ভেঙে পড়ে মশক নিধন কার্যক্রম। এরপর থেকে ডেঙ্গু মোকাবিলার সাধারণ কার্যক্রমগুলোও সেভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। আর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মেয়রের স্থলে অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসক বসানোর পর নাগরিকসেবায় তারা কাজ শুরু করলেও অনেক কিছুই এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না। ফলে ডেঙ্গু প্রতিরোধসহ সিটি করপোরেশনের অনেক কাজই ঠিকমতো চলছে না, এতে সিটি করপোরেশনের ব্যর্থতায় ডিসেম্বরে এসেও ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
নাগরিকরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বছরের পর বছর ধরেই এতে ব্যর্থ ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। বর্তমান সময়ে হঠাৎ করে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং মশক নিধনে কার্যক্রম আগের মতো না পরিচালিত হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকার বাসিন্দারা। তারা বলছেন, পুরো সপ্তাহে মশক নিধনে কোনো কর্মীকে দেখা যায় না। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় রীতিমতো আতঙ্কিত তারা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ২১ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা আসাদুজ্জামান খান বলেন, মশা নিধন কার্যক্রমে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মীদের এখন খুব একটা দেখা যায় । প্রতিদিনই শুনছি কেউ না কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। পাশাপাশি মশার উপদ্রবও খুব বেড়েছে। অথচ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মশা নিধনের পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাচ্ছি না।
১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আনোয়ারুল আলম বলেন, আগে মেয়রসহ কাউন্সিলররা মশক নিধন কার্যক্রম নিয়মিত তদারকি করতেন। আবার মশা বাড়লে আমরা সরাসরি অভিযোগ জানাতে পারতাম। কিন্তু বর্তমান সময়ে কোনো কাউন্সিলর নেই। এদিকে ডেঙ্গু বাড়ছে, মশার অত্যাচারও বেড়েছে অনেক। কিন্তু আমরা অভিযোগ জানানোর জায়গা পাচ্ছি না। এছাড়া, মশক নিধন কর্মীদেরও মাঠে দেখতে পাচ্ছি না। এভাবে চলতে থাকলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। এতে করে আমরা সবাই আতঙ্কিত।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন শনিরআখড়া এলাকার বাসিন্দা মোতালেব হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু মশার ওষুধ ছিটাতে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কর্মীদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের এলাকায় আগে থেকেই মশার উপদ্রব বেশি, বর্তমান সময়ে এসে এ উপদ্রব আরো বেড়েছে।
এদকে দুই সিটি করপোরেশনেরই দাবি, এডিস মশা বাসাবাড়ির আঙিনায় পরিত্যক্ত পাত্রে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে জন্মায়। এর দায় নাগরিকদের সবচেয়ে বেশি। তাই মশা নিধনে নিজ বাড়ির আঙিনা নিজেকেই নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে। আর বাইরে ড্রেন, নালা বা অন্য কোনো স্থানে মশা জন্মালে সিটি কর্পোরেশন তা নিধন করবে। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, এ বছর ডেঙ্গু সংক্রমণের বিস্তার শুরু থেকেই স্থানীয় পর্যায়ে বেশি থাকলেও ক্রমে সে চিত্র বদলেছে। সারা দেশে মোট ভর্তি রোগীর ৪৪ শতাংশই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। আর ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ রোগী চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে।
বিগত বছরগুলোতে মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপ হাতে নিয়েছিল ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। দুই বছর আগে মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করেছিল ডিএনসিসি। এছাড়া, শহরজুড়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এডিস মশার প্রজননস্থল এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ পরিত্যক্ত পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত টায়ার, কমোড ও অন্যান্য পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার উদ্যোগ নেয় সংস্থাটি। যদিও এসব তেমন কোনো কাজে আসেনি। তারা যখন এসব কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছিল, তখন মশা মারতে অভিনব এক পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্যোগ নিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। মশা মারতে দুই বছর আগে খাল, নালা, ড্রেনসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাঙ ছেড়েছিল সংস্থাটি। তবে এবার এমন কোনো পদক্ষেপই তেমন দেখা যায়নি। মশক নিধন কার্যক্রমও সঠিকভাবে পরিচালিত না হওয়ায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দুই সিটি করপোরেশন ব্যর্থ হয়েছে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
এবিষয়ে জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় সামনের দিনগুলোর পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে চলেছে। একে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আগামী দিনগুলোয় ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে। তাই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও সিটি কর্পোরেশনকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম আরও বেগবান করতে হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র আবু নাছের বলেন, মশক নিয়ন্ত্রণে দৈনন্দিন নিয়মিত কার্যক্রমের পাশাপাশি সব ওয়ার্ডে ক্রমান্বয়ে বিশেষ পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা ও মশক নিধন কার্যক্রম, চিরুণি অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র মকবুল হোসাইন বলেন, সপ্তাহব্যাপী মশক নিধনে পরিচালিত বিশেষ কার্যক্রমে এক লাখ ২১ হাজার ৮৮৬টি বাড়ি পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫১টি বাড়িতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যায়। এসব লার্ভা ধ্বংস করা হয়েছে। মশা নিধনে আমাদের কোনো কার্যক্রমই থেমে নেই। মশক নিধনে যাবতীয় কার্যক্রমের পাশাপাশি জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও আমরা পরিচালনা করছি।


























