০৬:৪৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ডেঙ্গু নিয়ে বাণিজ্য

  • ডেঙ্গুর ‘রেড জোনে’ রাজধানীর ১৩টি ওয়ার্ড
  •  ভুল রিপোর্টে বিপাকে চিকিৎসকরা
  • ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বাড়তি অর্থ আদায়
  •  ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরাও
  •  দাম বাড়িয়েছেন মশা তাড়ানোর কয়েলের

 অতিরিক্ত রোগী থাকায় শুধু ইনডোরের রোগীদের পরীক্ষা করা হয়। তবে ক্লিনিক থেকে উল্টাপাল্টা রিপোর্ট হলে রোগীর চিকিৎসা করাটাও চিকিৎসকের জন্য বিপদজনক- ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম, তত্ত্বাবধায়ক, বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল

 

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু বর্তমানে সারা বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে পুঁজি করে স্বাস্থ্য খাতকে পরিণত করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার খোলার সুযোগ আছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে অসাধু একটি মহল। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন ধরনের সংকট রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর একটি হলো অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অবাধ বিস্তার।

সারাদেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এ অবস্থায় হাসপাতালে রোগীদের চাপে পরীক্ষা সঙ্কটে বেশিরভাগ রোগী ছুটছেন বাইরের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তবে এসব পরীক্ষায় একের পর এক ভুল রিপোর্ট ধরা পড়ায় চিকিৎসা দিতে বিপাকে পড়ছেন চিকিৎসকরা। অপরদিকে একই পরীক্ষা বারবার করায় বাড়তি টাকা খরচের ভোগান্তি ভুক্তভোগীদের।

রাজধানীতে মৌসুমের আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত প্রাক-বর্ষা জরিপে এই তথ্য ওঠে এসেছে। গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত ‘মৌসুম পূর্ব এডিস সার্ভে-২৫’ ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।

এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রেটো ইনডেক্স’। এই সূচকে কোনো এলাকায় লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হলে সেটিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ধরা হয়। জরিপ অনুযায়ী, দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টিতে ব্রেটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। অর্থাৎ এসব এলাকায় প্রতি ১০০টি পাত্রের মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এতে এসব এলাকা ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো: ২, ৮, ১২, ১৩, ২২, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো: ৩, ৪, ২৩, ৩১, ৪১, ৪৬, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড।

সরেজমিনে বরগুনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৫৫টি বেডের বিপরীতে প্রায় দেড় শতাধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের মধ্যে গত তিন দিন আগে ৯৩ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন বরগুনা সদর উপজেলার খেজুরতলা নামক এলাকার বাসিন্দা মো. সাগর। এর এক দিন পর ১৬ জুন হাসপাতালের বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তিনি পরীক্ষা করেন। এ সময় ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দেওয়া রিপোর্টে সাগরের মাত্র ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয়। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকদের সন্দেহ হলে পুনরায় পরীক্ষা করতে বললে একই দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টার ব্যবধানে আরেকটি ক্লিনিকের পরীক্ষায় সাগরের প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয় ১ লাখ ৪৯ হাজার।

ভুক্তভোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সাগর বলেন, ডাক্তারকে শারীরিক অবস্থা জানাতে বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করি। সেখান থেকে আমার ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করে রিপোর্ট দেওয়া হয়। রিপোর্ট দেখে আমি ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি করে বরিশাল যেতে চাই। এ ছাড়া ভয়ে আমার বুক কাঁপা শুরু করে। পরে ওই রিপোর্টটি ডাক্তারকে দেখালে রিপোর্টে ভুল হয়েছে জানিয়ে আবারও পরীক্ষা করতে বলেন। পরবর্তী অন্য একটি ক্লিনিকে পরীক্ষা করলে ১ লাখ ৪৯ হাজার প্লাটিলেট আছে এমন রিপোর্ট দেওয়া হয়। ফোরকান নামে সাগরের এক মামা বলেন, বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সোহাগের পরীক্ষায় ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করে রিপোর্ট দেয়। তবে ওই রিপোর্ট ভুল হয়েছে বলে ডাক্তার আবারও পরীক্ষা করতে বলেন। আমারা এমনিতেই রোগী নিয়ে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির মধ্যে থাকি। এরপর আবার ভুল রিপোর্টের কারণে এক পরীক্ষা বারবার করে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়। জানা যায়, শুধু সাগর নয় আরও অনেকেরই পরীক্ষার রিপোর্ট ভুল দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন রোগী ও স্বজনদের। খেজুরতলা এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম নামে আরও এক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গেও ঘটেছে এমন ঘটনা। তিনি গত শুক্রবার ৬৭ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরদিন স্থানীয় অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করালে তার প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার। তবে এক দিনের ব্যবধানে এমন রিপোর্ট দেখে সন্দেহ হয় চিকিৎসকের। পরে আরেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করালে প্লাটিলেট দেখায় ৫৪ হাজার। এর আগে গত ১১ জুন একই ক্লিনিক থেকে ১০ বছর বয়সী তানিয়া নামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এক শিশুর পরীক্ষায়ও দেওয়া হয় ভুল রিপোর্ট। ক্লিনিকের দেওয়া রিপোর্টে তার প্লাটিলেট দেখায় ১৮ লাখ ৯৫ হাজার। ভুক্তভোগী মরিয়ম বলেন, পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ডাক্তার আমাকে আবারও পরীক্ষা করতে বলেছেন। কি হয়েছে বা না হয়েছে আমি তা বলতে পারি না।  হাসপাতালে ভর্তি ১৩ বছর বয়সী মুসা নামে এক রোগীর স্বজন মো. আব্দুস সালাম বলেন, সোমবার প্রথমে অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করলে ৪৭ হাজার প্লাটিলেট পাওয়া যায়। পরে একই সময়ে আরেকটি ক্লিনিকে পরীক্ষা করালে ৮৯ হাজার প্লাটিলেটের রিপোর্ট দেওয়া হয়। একেক ক্লিনিকের একেক ধরনের রিপোর্ট, কোন রিপোর্টটি সঠিক তা আমরা কিভাবে বুঝবো। ভুল রিপোর্ট রোগীকে প্রদান করার বিষয়ে অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সজীব বলেন, টাইপিং ভুলের কারণে রিপোর্ট ভুল হতে পারে। তবে এসব ভুল অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়েছে। বরগুনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের মেশিনটি দামি। বাইরের ক্লিনিকগুলোতে যে মেশিন রয়েছে তা কম দামের এবং অনেক নিম্নমানের। সে কারণে বাইরে থেকে অনেক সময় সঠিক রিপোর্ট আসে না। যদি হাসপাতালেই রোগীদের এ পরীক্ষাটি করা হয় তাহলে রোগীরা সঠিক রিপোর্ট এবং সঠিক চিকিৎসা পাবে। এ ছাড়া রোগীদের হয়রানি বন্ধের পাশাপাশি তাদের বাড়তি টাকাও খরচ হবে না। বরগুনার বেসরকারি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মানোন্নয়নে নিয়ন্ত্রণকারী দপ্তরকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে হাসপাতালে দায়িত্বরত মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. আশিকুর রহমান বলেন, রিপোর্ট নিয়ে আমাদের চিন্তায় পড়তে হয়। কিছু কিছু রিপোর্ট দেখেই তা অসামঞ্জস্য মনে হয়। তখন আমরা রোগীকে কষ্ট হলেও আরেকবার আরেক জায়গায় পুনরায় পরীক্ষা করতে বলি। তবে এতে রোগীদের অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়। আমাদের হাসপাতালে পরীক্ষা হয় তবে অতিরিক্ত রোগীর চাপে ভীড় এড়াতে অনেকেই বাইরে থেকে পরীক্ষা করেন। প্লাটিলেট যেহেতু আমরা চোখে দেখি না তাই রিপোর্টটের ওপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা দিতে হয়। তবে আমরা আগের রিপোর্টের সঙ্গে বর্তমান রিপোর্ট মিলিয়ে দেখে যদি খুব বেশি পার্থক্য আসে তাহলে রোগীকে আবারও পরীক্ষা করতে বলি। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে সিভিসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তবে অতিরিক্ত ভর্তি থাকায় শুধু ইনডোরের রোগীদের পরীক্ষা করা হয়। আশা করি, খুব দ্রুতই বেশি পরিমাণ পরীক্ষা হাসপাতালেই করা যাবে। তবে বাইরের ক্লিনিক থেকে উল্টাপাল্টা রিপোর্ট হলে রোগীর চিকিৎসা করাটাও চিকিৎসকের জন্য বিপদজনক। বরগুনার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত গৌরিচন্না ইউনিয়নের বাসিন্দা তাহমিনা আক্তার। ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৩ বছরের সন্তান মুসাকে নিয়ে দুঃচিন্তায় দিন পার করছেন সদর হাসপাতালে। গত ১৬ জুন ২-৩ ঘণ্টার ব্যবধানে অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক, উপকূল ডায়গনস্টিক ও সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করান। তবে একেক প্রতিষ্ঠানের আলাদা আলাদা রিপোর্টে হতাশ তাহমিনা। তাহমিনা জানান, একেক জায়গায় একেক রকম রিপোর্ট আসে। কিভাবে বুঝবো কোনটা সঠিক। জেলায় ১২০টির বেশি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই নেই সরকারি অনুমোদন। মানহীন এসব ডায়াগনস্টিকের বিরুদ্ধে রয়েছে বাড়তি অর্থ নেয়ার অভিযোগ। ভুক্তভোগীরা জানান, এক জায়গায় পরীক্ষা করিয়ে এক হাজার টাকা নিয়েছে, আরেক জায়গায় পরীক্ষা করাতে এক হাজার চার শ’ টাকা নিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, চাপ বেড়ে যাওয়ায় ডেঙ্গু পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বেড়েছে বাড়তি চাপ। বরগুনা সদর হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা ডা. তাজকিয়া সিদ্দিকাহ বলেন, এই রকম মহামারিতে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করা এইটা তো প্রতারণা। এটার ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। বরগুনা প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল হাসান বলেন, ডায়াগনস্টিক সমিতির একটা মূল্য তালিকা আছে। এই মূল্য তালিকার বাইরে যদি কেউ নেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে সমিতি থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। বেড়েছে মৃত্যুও। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা বাড়িয়েছেন মশার কয়েল ও মশা তাড়ানোর সরঞ্জামের দাম। এতে বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ। ভুক্তভোগীরা জানান, ছোট ছোট বাচ্চাদের মশারি দিয়েও রাখা যাচ্ছে না। অনেক সমস্যা হচ্ছে। এক প্যাকেট কয়েল কিনতে গেলে ৮০ টাকা বা ১০০ টাকা লাগে। স্প্রের দাম ৭০০ টাকা। এত টাকা দিয়ে এসব কেনার সামর্থ্য তো কারোর নেই। অসাধু ব্যবসায়ী ও মানহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের আশ্বাস পৌর প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের। বরগুনা পৌর প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ‘অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক যেগুলো আছে, যাদের বিরুদ্ধে মানহীন রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

সানজিদা তন্বীর বিয়ের খবর জানালেন ফেসবুকে নিজের হৃদয়গ্রাহী পোস্টে

ডেঙ্গু নিয়ে বাণিজ্য

আপডেট সময় : ০৭:২৯:৩৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ জুন ২০২৫
  • ডেঙ্গুর ‘রেড জোনে’ রাজধানীর ১৩টি ওয়ার্ড
  •  ভুল রিপোর্টে বিপাকে চিকিৎসকরা
  • ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বাড়তি অর্থ আদায়
  •  ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় সুযোগ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরাও
  •  দাম বাড়িয়েছেন মশা তাড়ানোর কয়েলের

 অতিরিক্ত রোগী থাকায় শুধু ইনডোরের রোগীদের পরীক্ষা করা হয়। তবে ক্লিনিক থেকে উল্টাপাল্টা রিপোর্ট হলে রোগীর চিকিৎসা করাটাও চিকিৎসকের জন্য বিপদজনক- ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম, তত্ত্বাবধায়ক, বরগুনা জেনারেল হাসপাতাল

 

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু বর্তমানে সারা বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে পুঁজি করে স্বাস্থ্য খাতকে পরিণত করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার খোলার সুযোগ আছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে অসাধু একটি মহল। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন ধরনের সংকট রয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয়গুলোর একটি হলো অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর অবাধ বিস্তার।

সারাদেশে মহামারি আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। এ অবস্থায় হাসপাতালে রোগীদের চাপে পরীক্ষা সঙ্কটে বেশিরভাগ রোগী ছুটছেন বাইরের বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। তবে এসব পরীক্ষায় একের পর এক ভুল রিপোর্ট ধরা পড়ায় চিকিৎসা দিতে বিপাকে পড়ছেন চিকিৎসকরা। অপরদিকে একই পরীক্ষা বারবার করায় বাড়তি টাকা খরচের ভোগান্তি ভুক্তভোগীদের।

রাজধানীতে মৌসুমের আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩টি ওয়ার্ডে এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি। জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত প্রাক-বর্ষা জরিপে এই তথ্য ওঠে এসেছে। গতকাল বুধবার বিকেলে রাজধানীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত ‘মৌসুম পূর্ব এডিস সার্ভে-২৫’ ফলাফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়।

এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের সূচক ‘ব্রেটো ইনডেক্স’। এই সূচকে কোনো এলাকায় লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হলে সেটিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ধরা হয়। জরিপ অনুযায়ী, দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৩টিতে ব্রেটো ইনডেক্স ২০-এর বেশি। অর্থাৎ এসব এলাকায় প্রতি ১০০টি পাত্রের মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এতে এসব এলাকা ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো: ২, ৮, ১২, ১৩, ২২, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ডগুলো হলো: ৩, ৪, ২৩, ৩১, ৪১, ৪৬, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ড।

সরেজমিনে বরগুনা ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নির্ধারিত ৫৫টি বেডের বিপরীতে প্রায় দেড় শতাধিক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের মধ্যে গত তিন দিন আগে ৯৩ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন বরগুনা সদর উপজেলার খেজুরতলা নামক এলাকার বাসিন্দা মো. সাগর। এর এক দিন পর ১৬ জুন হাসপাতালের বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তিনি পরীক্ষা করেন। এ সময় ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দেওয়া রিপোর্টে সাগরের মাত্র ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয়। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকদের সন্দেহ হলে পুনরায় পরীক্ষা করতে বললে একই দিনে তিন থেকে চার ঘণ্টার ব্যবধানে আরেকটি ক্লিনিকের পরীক্ষায় সাগরের প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয় ১ লাখ ৪৯ হাজার।

ভুক্তভোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী সাগর বলেন, ডাক্তারকে শারীরিক অবস্থা জানাতে বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করি। সেখান থেকে আমার ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করে রিপোর্ট দেওয়া হয়। রিপোর্ট দেখে আমি ভয় পেয়ে তড়িঘড়ি করে বরিশাল যেতে চাই। এ ছাড়া ভয়ে আমার বুক কাঁপা শুরু করে। পরে ওই রিপোর্টটি ডাক্তারকে দেখালে রিপোর্টে ভুল হয়েছে জানিয়ে আবারও পরীক্ষা করতে বলেন। পরবর্তী অন্য একটি ক্লিনিকে পরীক্ষা করলে ১ লাখ ৪৯ হাজার প্লাটিলেট আছে এমন রিপোর্ট দেওয়া হয়। ফোরকান নামে সাগরের এক মামা বলেন, বাইরের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে সোহাগের পরীক্ষায় ১ হাজার ২৬০ প্লাটিলেট পরিমাপ করে রিপোর্ট দেয়। তবে ওই রিপোর্ট ভুল হয়েছে বলে ডাক্তার আবারও পরীক্ষা করতে বলেন। আমারা এমনিতেই রোগী নিয়ে বিভিন্ন ধরনের হয়রানির মধ্যে থাকি। এরপর আবার ভুল রিপোর্টের কারণে এক পরীক্ষা বারবার করে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়। জানা যায়, শুধু সাগর নয় আরও অনেকেরই পরীক্ষার রিপোর্ট ভুল দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন রোগী ও স্বজনদের। খেজুরতলা এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম নামে আরও এক ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গেও ঘটেছে এমন ঘটনা। তিনি গত শুক্রবার ৬৭ হাজার প্লাটিলেট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরদিন স্থানীয় অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করালে তার প্লাটিলেট পরিমাপ করা হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার। তবে এক দিনের ব্যবধানে এমন রিপোর্ট দেখে সন্দেহ হয় চিকিৎসকের। পরে আরেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করালে প্লাটিলেট দেখায় ৫৪ হাজার। এর আগে গত ১১ জুন একই ক্লিনিক থেকে ১০ বছর বয়সী তানিয়া নামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত এক শিশুর পরীক্ষায়ও দেওয়া হয় ভুল রিপোর্ট। ক্লিনিকের দেওয়া রিপোর্টে তার প্লাটিলেট দেখায় ১৮ লাখ ৯৫ হাজার। ভুক্তভোগী মরিয়ম বলেন, পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে ডাক্তার আমাকে আবারও পরীক্ষা করতে বলেছেন। কি হয়েছে বা না হয়েছে আমি তা বলতে পারি না।  হাসপাতালে ভর্তি ১৩ বছর বয়সী মুসা নামে এক রোগীর স্বজন মো. আব্দুস সালাম বলেন, সোমবার প্রথমে অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করলে ৪৭ হাজার প্লাটিলেট পাওয়া যায়। পরে একই সময়ে আরেকটি ক্লিনিকে পরীক্ষা করালে ৮৯ হাজার প্লাটিলেটের রিপোর্ট দেওয়া হয়। একেক ক্লিনিকের একেক ধরনের রিপোর্ট, কোন রিপোর্টটি সঠিক তা আমরা কিভাবে বুঝবো। ভুল রিপোর্ট রোগীকে প্রদান করার বিষয়ে অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সজীব বলেন, টাইপিং ভুলের কারণে রিপোর্ট ভুল হতে পারে। তবে এসব ভুল অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়েছে। বরগুনা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি মনির হোসেন কামাল বলেন, প্লাটিলেট পরীক্ষার জন্য হাসপাতালের মেশিনটি দামি। বাইরের ক্লিনিকগুলোতে যে মেশিন রয়েছে তা কম দামের এবং অনেক নিম্নমানের। সে কারণে বাইরে থেকে অনেক সময় সঠিক রিপোর্ট আসে না। যদি হাসপাতালেই রোগীদের এ পরীক্ষাটি করা হয় তাহলে রোগীরা সঠিক রিপোর্ট এবং সঠিক চিকিৎসা পাবে। এ ছাড়া রোগীদের হয়রানি বন্ধের পাশাপাশি তাদের বাড়তি টাকাও খরচ হবে না। বরগুনার বেসরকারি ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মানোন্নয়নে নিয়ন্ত্রণকারী দপ্তরকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে হাসপাতালে দায়িত্বরত মেডিসিন কনসালটেন্ট ডা. আশিকুর রহমান বলেন, রিপোর্ট নিয়ে আমাদের চিন্তায় পড়তে হয়। কিছু কিছু রিপোর্ট দেখেই তা অসামঞ্জস্য মনে হয়। তখন আমরা রোগীকে কষ্ট হলেও আরেকবার আরেক জায়গায় পুনরায় পরীক্ষা করতে বলি। তবে এতে রোগীদের অতিরিক্ত টাকা খরচ হয়। আমাদের হাসপাতালে পরীক্ষা হয় তবে অতিরিক্ত রোগীর চাপে ভীড় এড়াতে অনেকেই বাইরে থেকে পরীক্ষা করেন। প্লাটিলেট যেহেতু আমরা চোখে দেখি না তাই রিপোর্টটের ওপর ভিত্তি করেই চিকিৎসা দিতে হয়। তবে আমরা আগের রিপোর্টের সঙ্গে বর্তমান রিপোর্ট মিলিয়ে দেখে যদি খুব বেশি পার্থক্য আসে তাহলে রোগীকে আবারও পরীক্ষা করতে বলি। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. রেজওয়ানুর আলম বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে সিভিসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তবে অতিরিক্ত ভর্তি থাকায় শুধু ইনডোরের রোগীদের পরীক্ষা করা হয়। আশা করি, খুব দ্রুতই বেশি পরিমাণ পরীক্ষা হাসপাতালেই করা যাবে। তবে বাইরের ক্লিনিক থেকে উল্টাপাল্টা রিপোর্ট হলে রোগীর চিকিৎসা করাটাও চিকিৎসকের জন্য বিপদজনক। বরগুনার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত গৌরিচন্না ইউনিয়নের বাসিন্দা তাহমিনা আক্তার। ডেঙ্গু আক্রান্ত ১৩ বছরের সন্তান মুসাকে নিয়ে দুঃচিন্তায় দিন পার করছেন সদর হাসপাতালে। গত ১৬ জুন ২-৩ ঘণ্টার ব্যবধানে অ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক, উপকূল ডায়গনস্টিক ও সদর হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষা করান। তবে একেক প্রতিষ্ঠানের আলাদা আলাদা রিপোর্টে হতাশ তাহমিনা। তাহমিনা জানান, একেক জায়গায় একেক রকম রিপোর্ট আসে। কিভাবে বুঝবো কোনটা সঠিক। জেলায় ১২০টির বেশি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। যাদের বেশিরভাগই নেই সরকারি অনুমোদন। মানহীন এসব ডায়াগনস্টিকের বিরুদ্ধে রয়েছে বাড়তি অর্থ নেয়ার অভিযোগ। ভুক্তভোগীরা জানান, এক জায়গায় পরীক্ষা করিয়ে এক হাজার টাকা নিয়েছে, আরেক জায়গায় পরীক্ষা করাতে এক হাজার চার শ’ টাকা নিয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, চাপ বেড়ে যাওয়ায় ডেঙ্গু পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে বেড়েছে বাড়তি চাপ। বরগুনা সদর হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা ডা. তাজকিয়া সিদ্দিকাহ বলেন, এই রকম মহামারিতে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করা এইটা তো প্রতারণা। এটার ব্যাপারে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। বরগুনা প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল হাসান বলেন, ডায়াগনস্টিক সমিতির একটা মূল্য তালিকা আছে। এই মূল্য তালিকার বাইরে যদি কেউ নেয় তাহলে তার বিরুদ্ধে সমিতি থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। বেড়েছে মৃত্যুও। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীরা বাড়িয়েছেন মশার কয়েল ও মশা তাড়ানোর সরঞ্জামের দাম। এতে বিপাকে নিম্ন আয়ের মানুষ। ভুক্তভোগীরা জানান, ছোট ছোট বাচ্চাদের মশারি দিয়েও রাখা যাচ্ছে না। অনেক সমস্যা হচ্ছে। এক প্যাকেট কয়েল কিনতে গেলে ৮০ টাকা বা ১০০ টাকা লাগে। স্প্রের দাম ৭০০ টাকা। এত টাকা দিয়ে এসব কেনার সামর্থ্য তো কারোর নেই। অসাধু ব্যবসায়ী ও মানহীন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপের আশ্বাস পৌর প্রশাসক ও সিভিল সার্জনের। বরগুনা পৌর প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ‘অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক যেগুলো আছে, যাদের বিরুদ্ধে মানহীন রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।