- ক্ষুদেবার্তার মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা আয় টেলকো প্রতিষ্ঠানগুলোর
- লেনদেনের পরিমাণ এবং সরকারের রাজস্ব ফাঁকি : তথ্য তদারকির ব্যবস্থা নেই বিটিআরসির কাছে
‘বিটিআরসি চাইলে মাত্র এক মাসেই এমন ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারে, যা দিয়ে দেশে আসা আন্তর্জাতিক এসএমএস তদারকি করা সম্ভব’ Ñআনোয়ার হাসান সাবির, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ
‘আন্তর্জাতিক এসএমএসের বিষয়ে একটি নীতিমালা করে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই সেটি কার্যকর করা হবে’ Ñমেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী, চেয়ারম্যান, বিটিআরসি
বিদেশ থেকে বাংলাদেশের মোবাইল ব্যবহারকারীদের কাছে আসা ‘শর্ট মেসেজ সার্ভিস (এসএমএস)’ বা ক্ষুদেবার্তা থেকে মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর (এমএনও) তথা টেলকো প্রতিষ্ঠানগুলোর কোটি কোটি টাকা আয় হচ্ছে। এ বাবদ বছরে অন্তত ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার লেনদেনের প্রায় সবটুকুই হচ্ছে দেশের বাইরে। আর নামমাত্র তথ্যের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হচ্ছে একেবারে সামান্য। এদিকে, দেশে কার্যক্রমে থাকা এমএনওগুলো ঠিক কী পরিমাণ আন্তর্জাতিক এসএমএস দেশে আনছে এবং সেগুলো থেকে ঠিক কী পরিমাণ আয় হচ্ছে; সেসব তথ্য তদারকির ব্যবস্থা নেই নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) কাছে। ফলে টেলকো প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া তথ্য আর রাজস্ব নিয়েই ‘সন্তুষ্ট’ থাকতে হয় সংস্থাটিকে। তবে বিটিআরসি জানিয়েছে, অচিরেই এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা কার্যকর হতে যাচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে থেকে বাংলাদেশের মোবাইল ব্যবহারকারীদের কাছে আসা ক্ষুদেবার্তাগুলোই আন্তর্জাতিক এসএমএস। এই এসএমএসগুলো দুই ধরনের যথা ‘অ্যাপ্লিকেশন টু পারসন (এটুপি)’ এবং ‘পারসন টু পারসন (পিটুপি)’। তবে বর্তমান সময়ে বিদেশ থেকে এটুপি এসএমএসই বেশি আসে দেশীয় ব্যবহারকারীদের কাছে। আর এটুপি এসএমএসের সিংহভাগ আবার ‘ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি)’ এসএমএস। ফেসবুক, গুগল, হোয়াটস অ্যাপ, নেটফ্লিক্সের মতো প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোতে অ্যাকাউন্ট বা আইডি খুলতে এবং সেগুলোতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ওটিপি এসএমএস পাঠানো হয়। গুগল, ফেসবুক বা এদের মতো প্রতিষ্ঠানের এসএমএস বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মোবাইল ব্যবহারকারীদের কাছে পৌঁছে দিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটর’ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই এগ্রিগেটরদের সঙ্গে টেলকোগুলোর চুক্তি থাকে। গুগল তার এসএমএসগুলো তেমনি একটি ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটরকে দেয়, আর সেই এগ্রিগেটর এসএমএসকে টেলিকম অপারেটরের কাছে দেয়। সবশেষে সেখান থেকে ব্যবহারকারী সেই আন্তর্জাতিক এসএমএস পায়’। এভাবেই আন্তর্জাতিক এসএমএস বাংলাদেশের একজন মোবাইল ব্যবহারকারীর কাছে আসে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বাংলাদেশের এমএনও তথা গ্রামীণফোন, রবি (এয়ারটেল), বাংলালিংক এবং টেলিটকের কাছে আন্তর্জাতিক এসএমএস নিয়ে আসতে ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটর হিসেবে কাজ করে ‘চিঞ্জ’, ‘জিএমএস’ এবং ‘ইনফোবিপ’র মতো প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এমএনও প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানা বা মূল প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়। মালিকানা এসব প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরেই এসব চুক্তি করে এবং এসএমএস বাবদ লেনদেনও দেশের বাইরেই সম্পন্ন হয়। টেলকোগুলোর মধ্যে একমাত্র রাষ্ট্রীয় অপারেটর টেলিটক আন্তর্জাতিক এসএমএস ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশে আনে। এক্ষেত্রে টেলিটকের ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটর হিসেবে কাজ করে ইনফোবিপ এবং বাংলাদেশের লোকাল পার্টনার হিসেবে থাকে উইনটেল।
টেলিকম খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেলিটকের কোনো মালিকানা প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরে থাকার সুযোগ না থাকায়, ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটরদের দেশেই চুক্তি করতে হয়। তবে অভিযোগ আছে, আন্তর্জাতিক এসএমএসের প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক কম আয় দেখানো হয় টেলিটকে, আর সেই অনুযায়ীই রাজস্ব বিনিময় (রেভিনিউ শেয়ারিং) করা হয় বিটিআরসির সঙ্গে। দেশে এটুপি এসএমএস এগ্রিগেটর হিসেবে নিবন্ধিত একটি সূত্রের মতে, প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৭ লাখ আন্তর্জাতিক এসএমএস আসে টেলিটক ব্যবহারকারীদের কাছে। প্রতি এসএমএসের বিপরীতে টেলিটকের আয় দেখানো হয় মার্কিন মুদ্রায় গড়ে ৬ থেকে ৭ সেন্ট (১০০ সেন্টে ১ মার্কিন ডলার) যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ টাকা। তবে খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্য এমএনওগুলোর সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটরদের এসএমএস প্রতি ১২ থেকে ২৫ সেন্টের চুক্তি হয়। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৫ থেকে ৩০ টাকা। সেই হিসাবে এসএমএস প্রতি এমএনওদের আয় হয় গড়ে ২৫ টাকা। অবশ্য কখনো কখনো ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটররা অপারেটরদের সঙ্গে নির্দিষ্ট অঙ্কের বিনিময়ে বছর হিসেবে ‘আনলিমিটেড’ বা ‘বাল্ক’ এসএমএসের চুক্তি করে।
এদিকে, দেশে প্রতি মাসে প্রায় ৪ কোটি আন্তর্জাতিক এসএমএস আসে। এসএমএসের মাসিক গড় সম্প্রতি ৫ কোটিকেও ছাড়িয়ে যায়। এই হিসাবে এসএমএস প্রতি ২৫ টাকা গড় ধরলে, আর মাসিক এসএমএসের গড় ৪ কোটি হিসাবে, আন্তর্জাতিক এসএমএস বাবদ প্রতি মাসে এমএনওগুলোর আয় হচ্ছে ১০০ কোটি টাকা। ফলে বছর হিসাবে এই লেনদেনের পরিমাণ অন্তত ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ এটুপি এসএসএম এগ্রিগেটর নীতিমালা অনুযায়ী, এসএমএস থেকে আয়ের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ দিতে হয় বিটিআরসি তথা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। সেই হিসাবে, বছরের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মধ্যে থেকে ৭৮ কোটি টাকা পাওয়ার কথা বিটিআরসির। তবে টেলিটক বাদে বাকি এমএনওগুলোর সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিগেটরদের চুক্তি এবং লেনদেন দেশের বাইরে হওয়াতে, যেমন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে আসছে না, তেমনি সরকারও রাজস্ব থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। এদিকে, তদারকিতে অনীহা বিটিআরসির। তবে এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা কার্যকর হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ আনোয়ার হাসান সাবির বলেন, বিটিআরসি চাইলে মাত্র এক মাসেই এমন ব্যবস্থা দাঁড় করাতে পারে, যা দিয়ে দেশে আসা আন্তর্জাতিক এসএমএস তদারকি করা সম্ভব।
এ বিষয়ে বিটিআরসির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী বলেন, আন্তর্জাতিক এসএমএসের বিষয়ে একটি নীতিমালা করে এরই মধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলেই সেটি কার্যকর করা হবে। সেই নীতিমালার আলোকে আন্তর্জাতিক এসএমএসের জন্য লাইসেন্স দেওয়া হবে। তখন এই সমস্যার সমাধান হবে। নতুন লাইসেন্সিং পলিতে আইজিডবি¬উ স্তর না রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। আইজিডব্লিউর স্থলে যে ব্যবস্থা বা স্তর রাখা হবে, আন্তর্জাতিক এসএমএসকেও সেই ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে দেশে আনা হবে।


























