১১:১৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রপ্তানিতে সিডিউল বিপর্যয়

এনবিআরে অচলাবস্থার অবসান

আটকা পড়েছে ১৪ হাজার কনটেইনার

রাজস্ব ঘাটতি থাকলেও সংকট কাটিয়ে উঠছে এনবিআর, বললেন চেয়ারম্যান

কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টানা দুদিনের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে চট্টগ্রামের ১৯টি বেসরকারি ডিপোতে আটকা পড়েছে রপ্তানি পণ্যবাহী প্রায় ১৪ হাজার কনটেইনার। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের কাছে সিডিউল অনুযায়ী সময়মতো পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। যা রপ্তানিমুখী বিভিন্ন শিল্পকে ক্ষতির মুখে ফেলেছে। গত রোববার সন্ধ্যায় এনবিআরের শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার হলেও এর আগে শুল্কায়ন না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে যেতে পারেনি তিনটি কনটেইনারবাহী জাহাজ। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, জাহাজ তিনটিতে রপ্তানির তিন হাজার ৬৮০ টিইইউ কনটেইনার যাওয়ার কথা ছিল। কাস্টমসের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে কনটেইনারগুলো জাহাজীকরণ সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রোববার কাস্টমসের কর্মসূচি প্রত্যাহার হলেও নির্ধারিত সময়ে জাহাজীকরণ করতে না পারা কনটেইনারগুলোর এখন আর সময়মতো বন্দর ছাড়ার সুযোগ নেই।
চেয়ারম্যানের পদত্যাগ ও যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে দুই দিনের শাটডাউন কর্মসূচি শেষে গতকাল সোমবার কাজে ফিরেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা। গতি ফিরেছে নিয়মিত কাজে। কর্মচাঞ্চল্য পরিবেশে দাফতরিক কাজ করছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। এর আগে গত রোববার মার্চ টু এনবিআর, কমপ্লিট শাটডাউনসহ সব ধরনের আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে ফিরেছেন আন্দোলনরত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা।
এদিকে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এখনো এনবিআর কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে সকালে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান কার্যালয়ে এসেছেন বলে জানা গেছে। এর আগে গত রোববার রাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক শেষ আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। তারা জানান, দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এবং দেশের আমদানি-রপ্তানি ও সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখা তথা অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে। তার আগে গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে বিভক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে এনবিআর বিলুপ্তি রোধসহ কয়েকটি দাবিতে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেন। গত ২৫ মে মন্ত্রণালয় ৩১ জুলাইয়ের আগে অধ্যাদেশটি সংশোধন করার আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ২২ জুন থেকে ফের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন তারা। সর্বশেষ গত ২৩ জুন শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত দুই দিন এই কর্মসূচি চলে।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেছেন, ভবিষ্যতে আর এমন সংকটময় পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে না। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, সবাই দায়িত্বশীল হলে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় তিনি এসব কথা বলেন।
গত সপ্তাহজুড়ে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি করে আন্দোলন করেছিল। পরে সরকারের কঠোর অবস্থানে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এই বিরতির পর আজ প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, এই কয়দিনের ধাক্কা থাকলেও সামগ্রিকভাবে রাজস্ব আদায় বাড়বে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সবাইকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে। চেয়ারম্যান জানান, গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তিনি আরও বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় চলতি বছর প্রবৃদ্ধি হবে। কয়েকদিনের মধ্যে আরও কিছু রাজস্ব আসবে। চূড়ান্ত হিসাব জানতে ২-৩ সপ্তাহ লাগবে। তবে আন্দোলনের কারণে আদায়ের গতি কিছুটা কমেছে বলেও স্বীকার করেন তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এনবিআর আদায় করেছিল ৩ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছর শুরুতে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যা এনবিআরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘাটতি হতে পারে।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাকশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুদিনে সিডিউল অনুযায়ী, কনটেইনার জাহাজীকরণ না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে তৈরি পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ পরিচালক এসএম আবু তৈয়ব বলেন, কাস্টমসের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে বন্দরে আমার কনটেইনারও আটকা পড়েছে। আমার মতো অনেকের প্রতিষ্ঠানের পণ্য সিডিউল থাকলেও জাহাজীকরণ হয়নি। আবার আমদানি পণ্যও খালাস নেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন জাহাজের ডেমারেজও আমাদের বহন করতে হবে। এতে পুরো শিল্প ক্ষতির মুখে পড়বে। কাস্টমসের অনুমোদন ছাড়া বন্দর থেকে আমদানি পণ্য খালাস বা পণ্য রপ্তানির কার্যক্রম করার সুযোগ থাকে না। শাটডাউন কর্মসূচির কারণে গত শনিবার থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত কাস্টমস কর্মকর্তারা কর্মস্থলে তালা ঝুলিয়ে দেন। এতে কোনো নথি অনুমোদন করা যায়নি। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ডিপো থেকে রপ্তানির কনটেইনার না আসায় তিনটি জাহাজ গন্তব্যে ছেড়ে যেতে পারেনি। এ তিন জাহাজের মধ্যে ‘হং ডা জিন-৬৮’ নামের একটি জাহাজে এক হাজার ৬৬৬ টিইইউ কনটেইনার রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। সোমবার সকাল পর্যন্ত জাহাজটি এনসিটি-৩ নম্বর বার্থে আটকা ছিল। একই ভাবে এক হাজার ৪৬০ টিইইউ কনটেইনার রপ্তানির কথা ছিল ‘এক্সপ্রেস নিলওয়ালা’ জাহাজটির। কিন্তু কনটেইনার না ওঠায় জাহাজটি এনসিটি-৫ নম্বর বার্থে বসা ছিল। পাশাপাশি গিয়ারড ভ্যাসেল ‘এএস সিসিলিয়া’ জাহাজ ৫৬৪ টিইইউ কনটেইনার নিয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কনটেইনার না ওঠায় সোমবার সকালেও জাহাজটি জিসিবি-৮ জেটিতে বসা ছিল। এএস সিসিলিয়া জাহাজটির লোকাল এজেন্ট মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) হেড অব অপারেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস আজমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, ডিপো থেকে রপ্তানি কনটেইনার না আসায় জাহাজটির বন্দর ছাড়া সম্ভব হয়নি। এ জাহাজের কনটেইনারগুলো সিঙ্গাপুরে নেওয়ার কথা ছিল। কনটেইনারগুলো সিঙ্গাপুর থেকে ইউরোপ ও আমেরিকাগামী বড় জাহাজে তুলে দেওয়ার সিডিউল ছিল। এখন সময়মতো কনটেইনারগুলো গন্তব্যে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মসূচিতে দুদিনের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে ২৫৭০ টিইইউ কনটেইনার বেড়েছে। দুইদিন শুল্কায়ন বন্ধ থাকায় মাত্র ৯১৩ টিইইউ কনটেইনার পণ্য খালাস হয়েছে, যেগুলোর নথি আগে শুল্কায়ন করা ছিল। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে ৪১ হাজার ৫৩২ টিইইউ কনটেইনার ছিল। এরমধ্যে সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় জাহাজ থেকে কনটেইনার বন্দরে নেমেছে ২২৫৩ টিইইউ, আর ঢাকা আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) থেকে এসেছে ৬৩ টিইইউ। অফডকগুলো থেকে রপ্তানিপণ্য ভর্তি কনটেইনার এসেছে ৪৯৩ টিইইউ এবং খালি কনটেইনার এসেছে ১৩৮১ টিইইউ। একই ভাবে জাহাজীকরণ হয়েছে ৩৪১২ টিইইউ কনটেইনার। ৭২ টিইইউ কনটেইনার ঢাকা আইসিডিতে পাঠানো হয়েছে। অফডকগুলোতে আমদানিপণ্য ভর্তি কনটেইনার পাঠানো হয়েছে ১৫৩ টিইইউ। বন্দর থেকে ৯০৯ টিইইউ খালি কনটেইনার অফডকগুলোতে পাঠানো হয়েছে। ৩৬৩ টিইইউ আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার অনচেচিজ সরাসরি আমদানিকারকদের ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বন্দরের অভ্যন্তর থেকে ২৫৮ টিইইউ কনটেইনার পণ্য খালাস দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, কাস্টমসের কর্মসূচির কারণে শনি ও রোববার শুল্কায়নসহ আমদানি-রপ্তানির স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এতে রপ্তানির জন্য কনটেইনারগুলো নির্ধারিত সময়ে জাহাজীকরণ সম্ভব হয়নি। যে কারণে কনটেইনার জাহাজগুলোকে সিডিউল অনুযায়ী বার্থিংয়ের সুযোগ দেওয়া যায়নি। এতে বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার জট বেড়েছে।

 

জনপ্রিয় সংবাদ

নায়ক রিয়াজের মৃত্যুসংবাদ ফেসবুকে, যা জানাল পরিবার

রপ্তানিতে সিডিউল বিপর্যয়

আপডেট সময় : ০৭:০৫:৩০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১ জুন ২০২৫

আটকা পড়েছে ১৪ হাজার কনটেইনার

রাজস্ব ঘাটতি থাকলেও সংকট কাটিয়ে উঠছে এনবিআর, বললেন চেয়ারম্যান

কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টানা দুদিনের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির কারণে চট্টগ্রামের ১৯টি বেসরকারি ডিপোতে আটকা পড়েছে রপ্তানি পণ্যবাহী প্রায় ১৪ হাজার কনটেইনার। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের কাছে সিডিউল অনুযায়ী সময়মতো পণ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। যা রপ্তানিমুখী বিভিন্ন শিল্পকে ক্ষতির মুখে ফেলেছে। গত রোববার সন্ধ্যায় এনবিআরের শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার হলেও এর আগে শুল্কায়ন না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে ছেড়ে যেতে পারেনি তিনটি কনটেইনারবাহী জাহাজ। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, জাহাজ তিনটিতে রপ্তানির তিন হাজার ৬৮০ টিইইউ কনটেইনার যাওয়ার কথা ছিল। কাস্টমসের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে কনটেইনারগুলো জাহাজীকরণ সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রোববার কাস্টমসের কর্মসূচি প্রত্যাহার হলেও নির্ধারিত সময়ে জাহাজীকরণ করতে না পারা কনটেইনারগুলোর এখন আর সময়মতো বন্দর ছাড়ার সুযোগ নেই।
চেয়ারম্যানের পদত্যাগ ও যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে দুই দিনের শাটডাউন কর্মসূচি শেষে গতকাল সোমবার কাজে ফিরেছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা। গতি ফিরেছে নিয়মিত কাজে। কর্মচাঞ্চল্য পরিবেশে দাফতরিক কাজ করছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা। এর আগে গত রোববার মার্চ টু এনবিআর, কমপ্লিট শাটডাউনসহ সব ধরনের আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে ফিরেছেন আন্দোলনরত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা।
এদিকে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে এখনো এনবিআর কার্যালয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে সকালে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান কার্যালয়ে এসেছেন বলে জানা গেছে। এর আগে গত রোববার রাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক শেষ আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। তারা জানান, দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এবং দেশের আমদানি-রপ্তানি ও সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখা তথা অর্থনীতির বৃহত্তর স্বার্থে এবং জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করেছে। তার আগে গত ১২ মে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে বিভক্ত করে অধ্যাদেশ জারি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে এনবিআর বিলুপ্তি রোধসহ কয়েকটি দাবিতে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে আন্দোলন শুরু করেন। গত ২৫ মে মন্ত্রণালয় ৩১ জুলাইয়ের আগে অধ্যাদেশটি সংশোধন করার আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ২২ জুন থেকে ফের চেয়ারম্যানের অপসারণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন তারা। সর্বশেষ গত ২৩ জুন শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গত দুই দিন এই কর্মসূচি চলে।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান বলেছেন, ভবিষ্যতে আর এমন সংকটময় পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে না। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, সবাই দায়িত্বশীল হলে যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে রাজস্ব ভবনে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় তিনি এসব কথা বলেন।
গত সপ্তাহজুড়ে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ চেয়ারম্যানের অপসারণ দাবি করে আন্দোলন করেছিল। পরে সরকারের কঠোর অবস্থানে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এই বিরতির পর আজ প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের মুখোমুখি হলেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
তিনি বলেন, এই কয়দিনের ধাক্কা থাকলেও সামগ্রিকভাবে রাজস্ব আদায় বাড়বে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সবাইকে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এগিয়ে আসতে হবে। চেয়ারম্যান জানান, গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তিনি আরও বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় চলতি বছর প্রবৃদ্ধি হবে। কয়েকদিনের মধ্যে আরও কিছু রাজস্ব আসবে। চূড়ান্ত হিসাব জানতে ২-৩ সপ্তাহ লাগবে। তবে আন্দোলনের কারণে আদায়ের গতি কিছুটা কমেছে বলেও স্বীকার করেন তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর এনবিআর আদায় করেছিল ৩ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছর শুরুতে আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি করা হয়। এই প্রেক্ষাপটে, চলতি অর্থবছরে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যা এনবিআরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘাটতি হতে পারে।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত পোশাকশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দুদিনে সিডিউল অনুযায়ী, কনটেইনার জাহাজীকরণ না হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে ক্রেতাদের কাছে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে তৈরি পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ পরিচালক এসএম আবু তৈয়ব বলেন, কাস্টমসের শাটডাউন কর্মসূচির কারণে বন্দরে আমার কনটেইনারও আটকা পড়েছে। আমার মতো অনেকের প্রতিষ্ঠানের পণ্য সিডিউল থাকলেও জাহাজীকরণ হয়নি। আবার আমদানি পণ্যও খালাস নেওয়া সম্ভব হয়নি। এখন জাহাজের ডেমারেজও আমাদের বহন করতে হবে। এতে পুরো শিল্প ক্ষতির মুখে পড়বে। কাস্টমসের অনুমোদন ছাড়া বন্দর থেকে আমদানি পণ্য খালাস বা পণ্য রপ্তানির কার্যক্রম করার সুযোগ থাকে না। শাটডাউন কর্মসূচির কারণে গত শনিবার থেকে রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত কাস্টমস কর্মকর্তারা কর্মস্থলে তালা ঝুলিয়ে দেন। এতে কোনো নথি অনুমোদন করা যায়নি। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ডিপো থেকে রপ্তানির কনটেইনার না আসায় তিনটি জাহাজ গন্তব্যে ছেড়ে যেতে পারেনি। এ তিন জাহাজের মধ্যে ‘হং ডা জিন-৬৮’ নামের একটি জাহাজে এক হাজার ৬৬৬ টিইইউ কনটেইনার রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। সোমবার সকাল পর্যন্ত জাহাজটি এনসিটি-৩ নম্বর বার্থে আটকা ছিল। একই ভাবে এক হাজার ৪৬০ টিইইউ কনটেইনার রপ্তানির কথা ছিল ‘এক্সপ্রেস নিলওয়ালা’ জাহাজটির। কিন্তু কনটেইনার না ওঠায় জাহাজটি এনসিটি-৫ নম্বর বার্থে বসা ছিল। পাশাপাশি গিয়ারড ভ্যাসেল ‘এএস সিসিলিয়া’ জাহাজ ৫৬৪ টিইইউ কনটেইনার নিয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কনটেইনার না ওঠায় সোমবার সকালেও জাহাজটি জিসিবি-৮ জেটিতে বসা ছিল। এএস সিসিলিয়া জাহাজটির লোকাল এজেন্ট মেডিটেরানিয়ান শিপিং কোম্পানির (এমএসসি) হেড অব অপারেশন অ্যান্ড লজিস্টিকস আজমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, ডিপো থেকে রপ্তানি কনটেইনার না আসায় জাহাজটির বন্দর ছাড়া সম্ভব হয়নি। এ জাহাজের কনটেইনারগুলো সিঙ্গাপুরে নেওয়ার কথা ছিল। কনটেইনারগুলো সিঙ্গাপুর থেকে ইউরোপ ও আমেরিকাগামী বড় জাহাজে তুলে দেওয়ার সিডিউল ছিল। এখন সময়মতো কনটেইনারগুলো গন্তব্যে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। কাস্টমস কর্মকর্তাদের কর্মসূচিতে দুদিনের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে ২৫৭০ টিইইউ কনটেইনার বেড়েছে। দুইদিন শুল্কায়ন বন্ধ থাকায় মাত্র ৯১৩ টিইইউ কনটেইনার পণ্য খালাস হয়েছে, যেগুলোর নথি আগে শুল্কায়ন করা ছিল। বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে ৪১ হাজার ৫৩২ টিইইউ কনটেইনার ছিল। এরমধ্যে সকাল পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় জাহাজ থেকে কনটেইনার বন্দরে নেমেছে ২২৫৩ টিইইউ, আর ঢাকা আইসিডি (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) থেকে এসেছে ৬৩ টিইইউ। অফডকগুলো থেকে রপ্তানিপণ্য ভর্তি কনটেইনার এসেছে ৪৯৩ টিইইউ এবং খালি কনটেইনার এসেছে ১৩৮১ টিইইউ। একই ভাবে জাহাজীকরণ হয়েছে ৩৪১২ টিইইউ কনটেইনার। ৭২ টিইইউ কনটেইনার ঢাকা আইসিডিতে পাঠানো হয়েছে। অফডকগুলোতে আমদানিপণ্য ভর্তি কনটেইনার পাঠানো হয়েছে ১৫৩ টিইইউ। বন্দর থেকে ৯০৯ টিইইউ খালি কনটেইনার অফডকগুলোতে পাঠানো হয়েছে। ৩৬৩ টিইইউ আমদানি পণ্যবাহী কনটেইনার অনচেচিজ সরাসরি আমদানিকারকদের ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বন্দরের অভ্যন্তর থেকে ২৫৮ টিইইউ কনটেইনার পণ্য খালাস দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, কাস্টমসের কর্মসূচির কারণে শনি ও রোববার শুল্কায়নসহ আমদানি-রপ্তানির স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এতে রপ্তানির জন্য কনটেইনারগুলো নির্ধারিত সময়ে জাহাজীকরণ সম্ভব হয়নি। যে কারণে কনটেইনার জাহাজগুলোকে সিডিউল অনুযায়ী বার্থিংয়ের সুযোগ দেওয়া যায়নি। এতে বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার জট বেড়েছে।