বাংলাদেশে গত ছয়দিনে গণপিটুনিতে ছয়জন নিহত হয়েছেন। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে পরবর্তী ১০ মাসে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যা ১৪৩ জন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি বা এইচআরএসএস। মানবাধিকার সংস্থা এইচআরএসএস এর হিসেব বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে গণপিটুনির ১০০৯টি ঘটনায় কমপক্ষে ৮১৬ জন নিহত হয়েছেন। গত ১০ বছরের মধ্যে ২০২৪ সালের পরিসংখ্যানে ‘সবচেয়ে ভীতিকর’ বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। গণপিটুনির সবশেষ ঘটনা ঘটে বৃহস্পতিবার। কুমিল¬ার মুরাদনগরে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগে রোববার গাজীপুরে চুরির অপবাদ দিয়ে কারখানায় এক শ্রমিককে রশি দিয়ে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। আর শনিবার রাজধানীর দারুস সালাম এলাকায় দুই যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। মানবাধিকার সংস্থা এইচআরএসএস এর হিসেব বলছে, ২০১৫ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে গণপিটুনির ১০০৯টি ঘটনায় কমপক্ষে ৮১৬ জন নিহত হয়েছেন। তবে প্রকৃত গণপিটুনির ঘটনা ও নিহত-আহতের সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতে পারে বলে উলে¬খ করেছে সংস্থাটি। গত ১০ বছরের মধ্যে ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান ‘সবচেয়ে ভীতিকর’ বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
গণপিটুনির ঘটনাগুলোর মধ্যে কতগুলো ঘটনার বিচার হয়েছে জানতে চাইলে মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, যতদূর মনে পড়ে শুধুমাত্র বাড্ডার রেনু বেগমের মামলাটির বিচার হয়েছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত অন্য কোনো ঘটনার বিচার হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। ২০১৯ সালের ২০ জুলাই ঢাকার বাড্ডায় স্কুল প্রাঙ্গণে ‘ছেলেধরা’ গুজবে তাসলিমা বেগম ওরফে রেনু নামে এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। সেদিন উত্তর-পূর্ব বাড্ডা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাসলিমা তার চার বছরের মেয়েকে ভর্তি করানোর বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত কয়েকজন নারী তাকে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহ করেন। এই গুজব দ্রুত বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। আশপাশ থেকে বিভিন্ন বয়সী কয়েকশ নারী-পুরুষ স্কুল প্রাঙ্গণে ঢুকে তাকে টেনে নামিয়ে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করেন।
কুমিল¬ার মুরাদনগরে বৃহস্পতিবার একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার বাঙ্গরা থানার আকবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন- রুবি বেগম (৫৮), তার ছেলে রাসেল (৩৫) ও মেয়ে জোনাকি আক্তার (২৭)। এই ঘটনায় আহত অপর মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে আমরা যেটা জানতে পেরেছি, দীর্ঘদিন ধরে এই পরিবারটি মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত। এ নিয়ে গ্রামবাসীর সঙ্গে তাদের একটা বিরোধ ছিল। এর প্রেক্ষিতেই এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। কেউ কি মবের মাধ্যমে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে? জানতে চাইলে ওসি বলেন, অবশ্যই না। এজন্য আমরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালাচ্ছি। পুলিশ পৌঁছার আগেই ঘটনাটি ঘটে গেছে।
স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত তিন থেকে চার দিন আগে একটি মোবাইল চুরির ঘটনা নিয়ে রুবি আক্তারের পরিবারের সঙ্গে স্থানীয়দের ঝগড়া হয়। সে সময় রুবি ও তার ছেলে বেশ কয়েকজনকে মারধর করেন। এ ঘটনার সূত্র ধরেই কড়ইবাড়ি গ্রামে বাসিন্দারা একত্রিত হয়ে রুবির বাড়িতে হামলা করে। ওই পরিবারের চার জনকে বেদম মারধর করে। এ সময় ঘটনাস্থলেই রুবি, তার মেয়ে জোনাকি ও ছেলে রাসেল নিহত হয়। রুবির অপর মেয়ে রমাকে পুলিশ গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। এলাকাবাসীর দাবি, মাদক ব্যবসা ও প্রতারণা করে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করা রুবি ও তার পরিবারের প্রতি গ্রামবাসী ক্ষুব্ধ ছিল। তার (রুবি) বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়াও সরকারি খাল দখল করে তার বিরুদ্ধে বাড়ি নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। এসব কারণে অনেকদিন ধরে তাদের উপর ক্ষুব্ধ ছিল মানুষ।
সম্প্রতি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদাকে ধরে এনে মবের নামে গলায় জুতোর মালা পরানো হয়। ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে একজনকে নুরুল হুদার মুখে জুতা দিয়ে আঘাত করতে দেখা গেছে। তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এই ঘটনাগুলোকে ‘মব’ বলতে রাজি নন। তার মতে, এগুলো জনরোষ। তার এমন বক্তব্য এক ধরনের ‘উসকানি’ বলে সমাজিক মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছেন। মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন ডয়চে ভেলেকে বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে দেশে এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে। সরকার মুখে শক্ত কথা বললেও কার্যত এমন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি যে কারণে মানুষ ভয় পাবে। ফলে সরকারকে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়ে দেখাতে হবে যে তারা এ ব্যাপারে মুখে নয়, কাজে শক্ত।
কেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না? জানতে চাইলে এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক মনিরা শারমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, সরকার আন্তরিক হলেও এখানে দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছে। আমরাও বারবার বলেছি, সরকারকে এ ব্যাপারে আরো কঠোর হতে হবে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনেকেই অভিযোগ করছেন, এনসিপি বিকল্প সরকার হিসেবে কাজ করছে। তারা যে দাবি করছে, সরকার সেটা মেনে নিচ্ছে। এই অভিযোগের ব্যাপারে মনিরা শারমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, এটা একেবারেই ভুয়া কথা। বরং সরকার বিএনপির দাবির প্রতি অনেক বেশি মনোযোগী। একজন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা যা বলছেন সরকার সেটা শুনছে। এমনকি অধিকাংশ থানার ওসি, ইউএনও তো বিএনপির কথায় উঠছে, বসছে। অনেকে আবার বিএনপি পরিবারের সদস্য বলে নিজেদের পরিচয় সামনে আনার চেষ্টা করছেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেউ কোনো দাবি নিয়ে যমুনার সামনে গেলেই সরকার সেটা মেনে নিচ্ছে। ফলে তারা তো বেপরোয়া হবেই। অন্যদিকে একজন উপদেষ্টা অস্ত্রের গুলি নিয়ে বিমানবন্দরে চলে যাচ্ছেন। সেখানেও কোনো আইন মানা হচ্ছে না। আবার তিনি বলছেন, ৫ আগস্ট সরকারের পতন না হলে আমরা অস্ত্র তুলে নিতাম। এখানে শব্দটা বলেছেন ‘আমরা’। এ বিষয়ে কি সরকার কোনো খোঁজখবর নিয়েছে? তাহলে আইনের শাসন আপনি কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবেন? এমন ঘটনা তো ঘটতেই থাকবে।
শিরোনাম
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন
আইনের শাসন না থাকায় গণপিটুনি, মব তৈরি বাড়ছে
-
সবুজ বাংলা রিপোর্ট - আপডেট সময় : ০৭:৫০:৪৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৫ জুলাই ২০২৫
- ।
- 110
জনপ্রিয় সংবাদ


























