০৬:২২ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

হাতিরঝিলের ‘মরণদশা’

  • কোথাও পিচ উঠে গেছে, কোথাও পাথর বেরিয়ে গেছে
  • বৃষ্টির পানি জমে গর্তে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা
  • আবর্জনা ও আগাছা সৌন্দর্য নষ্ট
  • জনসাধারণের চলাচলে ঝুঁকি বেড়েছে
  • লেকের পানি কালচে ও দুর্গন্ধযুক্ত

 

একসময় রাজধানীর প্রাণবন্ত বিনোদনকেন্দ্র ছিল হাতিরঝিল। ঝকঝকে রাস্তা, পরিষ্কার জলরাশি, আধুনিক আলোকসজ্জা এবং মনোরম পরিবেশ। কিন্তু দায়িত্বহীনতা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং অব্যবস্থাপনার কারণে নগরবাসীর প্রিয় স্থানটি এখন ভাঙাচোরা রাস্তা, দুর্গন্ধ ও নিরাপত্তাহীনতার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেছে। নগরবাসীর চলাচলের স্বাচ্ছন্দ্য এখন হুমকির মুখে। হাতিরঝিলের নান্দনিকতা এখন কেবলই অতীত স্মৃতি। সরেজমিনে দেখা যায়, হাতিরঝিলের চারপাশের রাস্তা এখন যেন গর্তের ফাঁদে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টির কিংবা শুকনো উভয় মৌসুমেই একই দুরবস্থা। কোথাও পিচ উঠে গেছে, কোথাও পাথর বেরিয়ে পড়েছে। বৃষ্টির পানি জমে গর্ত ঢেকে যায়, ফলে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার কিংবা রিকশা যানবাহন চলাচল হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই পথে চলাচল করে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে। রাজউকের হাতিরঝিল ব্যবস্থাপনা অফিসের পাশেই এখন অব্যবস্থাপনার চিত্র। ভবনের সামনে সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটুপানি জমে থাকে। ভেতরে সিঁড়ির নিচে কুকুর ঘুমায়, রিসেপশনে কেউ থাকে না। ভবনটি মূলত গাড়ির গ্যারেজ ও পার্কিং স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একজন অফিস সহকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে তেমন কোনো প্রশাসনিক কাজ হয় না। কর্মকর্তারা মতিঝিল অফিস থেকেই কাজ করেন। এদিকে, হাতিরঝিলের একসময়ের জনপ্রিয় ওয়াকওয়ে ও পার্কগুলোও এখন পরিত্যক্ত। কোথাও ভাঙা বেঞ্চ, কোথাও ভাঙা টাইলস, কোথাও ঘাসে ঢেকে গেছে হাঁটার পথ। তরুণদের আড্ডার জায়গা এখন নোংরা ও অরক্ষিত। রাতের বেলা পুরো এলাকা নিস্তব্ধ, কেবল মাঝে মাঝে মোটরসাইকেলের শব্দ বা ছিনতাইকারীদের আনাগোনা। স্থানীয় বাসিন্দা বেলার হোসেন বলেন, এক সময় এই জায়গাটা এত সুন্দর ছিল যে, সন্ধ্যার পর পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসতাম। এখন দুর্গন্ধে দাঁড়ানোই যায় না। রাস্তার গর্তে দুর্ঘটনা ঘটে প্রায়ই, আর রাতে আলো না থাকায় ছিনতাই বেড়েছে। বছরের পর বছর মেরামত হচ্ছে না।’ সেনাবাহিনীর হাতে থাকাকালে এমন অবস্থার কথা কেউ ভাবতেও পারত না বলে জানান এলাকার বাসিন্দারা। ভাঙা রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন চালকরা। প্রাইভেটকার চালক দেলায়ার হোসেন বলেন, এখন এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো মানেই যুদ্ধ করা। চাকা গর্তে পড়ে যায়, গাড়ির নিচের অংশ ঘষে যায় রাস্তায়। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা ডুবে যায়।
তবে নগরবিদরা বলছেন, সমস্যা কেবল মেরামতে সীমাবদ্ধ নয় এটি মূলত ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। রাজউকের হাতে অসংখ্য প্রকল্প থাকলেও তাদের তদারকি ও জনবল সীমিত। হাতিরঝিলের মতো সংবেদনশীল এলাকা রক্ষণাবেক্ষণে আলাদা কর্তৃপক্ষ বা করপোরেশন গঠন করা উচিত ছিল। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ‘হাতিরঝিল ম্যানেজমেন্ট অথরিটি’ গঠন করতে হবে। আর সেখানে রাজউক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পুলিশ, পরিবেশ অধিদফতর ও নাগরিক প্রতিনিধি থাকতে হবে। পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজউক হাতিরঝিলকে রাজস্বভিত্তিক প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করে মূল পরিকল্পনা ও হাইকোর্টের নির্দেশনা থেকে সরে এসেছে। ফলে সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত ও টেকসই হওয়া প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় এখন কোনো শক্ত নিয়ন্ত্রণ নেই। পয়ঃবর্জ্য ও আবর্জনা ফেলার ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, যা হাতিরঝিলের সৌন্দর্য ও নগরবাসীর ব্যবহারের উপযোগিতা নষ্ট করছে। বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, এমন বড় প্রকল্পগুলো টিকিয়ে রাখতে হলে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট থাকতে হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ অবকাঠামো প্রকল্প উদ্বোধনের পরই অবহেলায় পড়ে যায়। হাতিরঝিলও সেই ধারার ব্যতিক্রম নয়। এই ধরনের উন্নয়ন কেবল নির্মাণে সীমাবদ্ধ থাকলে তা টেকসই হয় না। রক্ষণাবেক্ষণ কাঠামো ও জবাবদিহি থাকতে হয়, না হলে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক সেটাই হচ্ছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, এটা এখন সিটি করপোরেশনের অধীনে আছে, যদিও অবোকাঠামোগত দিকগুলো রাজউক দেখভাল করে। এখন এগুলো এভাবে থাকছে, কারণ তাদের দায়বদ্ধতা নেই, কোনো জবাদিহিতা নেই। যদি বলি বিআরটিসি, বিআরডিএ, বিআরডিসি, সিটি করপোরেশন কোনো সরকারি জায়গায় দায়বদ্ধতা নেই। ফলে এমন হচ্ছে, কোনো সুরহা হচ্ছে না। এখন দরকার জবাদিহিতা। দায়িত্ব অবহেলার কারণে কোনো কর্মকর্তার চাকরি হারাতে হচ্ছে, এটার কোনো নজির বাংলাদেশে নেই। যদি জবাদিহিতা আর দায়বদ্ধতা অথবা চাকরি হারানোর ভয় থাকত তাহলে এই ধরনের অবহেলা করত না। ডিএসসিসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বৃষ্টির পানিতে রাস্তার সংস্কারকাজ দীর্ঘস্থায়িত্ব হারায়। বর্ষাকালে সড়কে জমে থাকা পানি মেরামতকাজের স্তর নষ্ট করে দিয়ে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে প্রলম্বিত বৃষ্টির সময়ে কোনো সংস্কার ও উন্নয়নকাজ শুরু করলে তা টেকসই হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে না। বর্ষার কারণে চলমান টেন্ডার প্রক্রিয়া ও মাঠপর্যায়ের প্রস্তুতিও মন্থর ছিল। যদিও টেন্ডার অনুমোদন শেষ হয়েছে, আবহাওয়ার অনিশ্চয়তার ফলে কাজ জোরদার করা সম্ভব হয়নি। এদিকে রাজউক বলছে, টেন্ডার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে সড়ক সংস্কারকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। বর্ষাকালের কারণে কাজের অনুকূল পরিবেশ না থাকায় পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নেও দেরি হয়। তবে বর্তমানে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে থাকা খানা-খন্দ মোকাবিলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেরামত কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছু স্থানে অস্থায়ীভাবে রিপেয়ারিং করে চলাচলে সাময়িক স্বস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে।
হাতিরঝিল প্রকল্প উদ্বোধন হয় ২০১৩ সালে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তৈরি এই প্রকল্প ছিল রাজধানীর অন্যতম সফল নগরায়ণ উদ্যোগ। লেক, সেতু, উড়ালসড়ক, ফুটপাথ, জলাধার সব কিছুই পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধান শেষ হয়ে রাজউকের হাতে দায়িত্ব যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় অবনতি। শুরুতে সামান্য ত্রুটি দেখা দিলেও সময়ের সঙ্গে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। ফার্মগেট থেকে তেজগাঁও হয়ে রামপুরা পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটারের এই সড়ক এক সময় শহরের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও মনোরম পথ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন তা খানাখন্দে ভরা। রাত নামলেই আলো না থাকার কারণে পুরো এলাকা অন্ধকারে ঢেকে যায়, সুযোগ নেয় ছিনতাইকারীরা। লেকের পানি কালচে হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়, আশপাশে জমে থাকা আবর্জনা আর আগাছায় সৌন্দর্যের কোনো ছাপ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।

জনপ্রিয় সংবাদ

সংসদে যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম কোতোয়ালীতে মনোনয়ন সংগ্রহে প্রার্থীদের ছড়াছড়ি

হাতিরঝিলের ‘মরণদশা’

আপডেট সময় : ০৭:২২:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৫
  • কোথাও পিচ উঠে গেছে, কোথাও পাথর বেরিয়ে গেছে
  • বৃষ্টির পানি জমে গর্তে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা
  • আবর্জনা ও আগাছা সৌন্দর্য নষ্ট
  • জনসাধারণের চলাচলে ঝুঁকি বেড়েছে
  • লেকের পানি কালচে ও দুর্গন্ধযুক্ত

 

একসময় রাজধানীর প্রাণবন্ত বিনোদনকেন্দ্র ছিল হাতিরঝিল। ঝকঝকে রাস্তা, পরিষ্কার জলরাশি, আধুনিক আলোকসজ্জা এবং মনোরম পরিবেশ। কিন্তু দায়িত্বহীনতা, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং অব্যবস্থাপনার কারণে নগরবাসীর প্রিয় স্থানটি এখন ভাঙাচোরা রাস্তা, দুর্গন্ধ ও নিরাপত্তাহীনতার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেছে। নগরবাসীর চলাচলের স্বাচ্ছন্দ্য এখন হুমকির মুখে। হাতিরঝিলের নান্দনিকতা এখন কেবলই অতীত স্মৃতি। সরেজমিনে দেখা যায়, হাতিরঝিলের চারপাশের রাস্তা এখন যেন গর্তের ফাঁদে পরিণত হয়েছে। বৃষ্টির কিংবা শুকনো উভয় মৌসুমেই একই দুরবস্থা। কোথাও পিচ উঠে গেছে, কোথাও পাথর বেরিয়ে পড়েছে। বৃষ্টির পানি জমে গর্ত ঢেকে যায়, ফলে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার কিংবা রিকশা যানবাহন চলাচল হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই পথে চলাচল করে দুর্ঘটনার আশঙ্কা নিয়ে। রাজউকের হাতিরঝিল ব্যবস্থাপনা অফিসের পাশেই এখন অব্যবস্থাপনার চিত্র। ভবনের সামনে সামান্য বৃষ্টিতেই হাঁটুপানি জমে থাকে। ভেতরে সিঁড়ির নিচে কুকুর ঘুমায়, রিসেপশনে কেউ থাকে না। ভবনটি মূলত গাড়ির গ্যারেজ ও পার্কিং স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একজন অফিস সহকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এখানে তেমন কোনো প্রশাসনিক কাজ হয় না। কর্মকর্তারা মতিঝিল অফিস থেকেই কাজ করেন। এদিকে, হাতিরঝিলের একসময়ের জনপ্রিয় ওয়াকওয়ে ও পার্কগুলোও এখন পরিত্যক্ত। কোথাও ভাঙা বেঞ্চ, কোথাও ভাঙা টাইলস, কোথাও ঘাসে ঢেকে গেছে হাঁটার পথ। তরুণদের আড্ডার জায়গা এখন নোংরা ও অরক্ষিত। রাতের বেলা পুরো এলাকা নিস্তব্ধ, কেবল মাঝে মাঝে মোটরসাইকেলের শব্দ বা ছিনতাইকারীদের আনাগোনা। স্থানীয় বাসিন্দা বেলার হোসেন বলেন, এক সময় এই জায়গাটা এত সুন্দর ছিল যে, সন্ধ্যার পর পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসতাম। এখন দুর্গন্ধে দাঁড়ানোই যায় না। রাস্তার গর্তে দুর্ঘটনা ঘটে প্রায়ই, আর রাতে আলো না থাকায় ছিনতাই বেড়েছে। বছরের পর বছর মেরামত হচ্ছে না।’ সেনাবাহিনীর হাতে থাকাকালে এমন অবস্থার কথা কেউ ভাবতেও পারত না বলে জানান এলাকার বাসিন্দারা। ভাঙা রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন চালকরা। প্রাইভেটকার চালক দেলায়ার হোসেন বলেন, এখন এই রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো মানেই যুদ্ধ করা। চাকা গর্তে পড়ে যায়, গাড়ির নিচের অংশ ঘষে যায় রাস্তায়। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তা ডুবে যায়।
তবে নগরবিদরা বলছেন, সমস্যা কেবল মেরামতে সীমাবদ্ধ নয় এটি মূলত ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। রাজউকের হাতে অসংখ্য প্রকল্প থাকলেও তাদের তদারকি ও জনবল সীমিত। হাতিরঝিলের মতো সংবেদনশীল এলাকা রক্ষণাবেক্ষণে আলাদা কর্তৃপক্ষ বা করপোরেশন গঠন করা উচিত ছিল। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে ‘হাতিরঝিল ম্যানেজমেন্ট অথরিটি’ গঠন করতে হবে। আর সেখানে রাজউক, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, পুলিশ, পরিবেশ অধিদফতর ও নাগরিক প্রতিনিধি থাকতে হবে। পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, রাজউক হাতিরঝিলকে রাজস্বভিত্তিক প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করে মূল পরিকল্পনা ও হাইকোর্টের নির্দেশনা থেকে সরে এসেছে। ফলে সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই এলাকার রক্ষণাবেক্ষণ নিয়মিত ও টেকসই হওয়া প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং অবকাঠামো ব্যবস্থাপনায় এখন কোনো শক্ত নিয়ন্ত্রণ নেই। পয়ঃবর্জ্য ও আবর্জনা ফেলার ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, যা হাতিরঝিলের সৌন্দর্য ও নগরবাসীর ব্যবহারের উপযোগিতা নষ্ট করছে। বুয়েটের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, এমন বড় প্রকল্পগুলো টিকিয়ে রাখতে হলে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট থাকতে হয়। আমাদের দেশে বেশির ভাগ অবকাঠামো প্রকল্প উদ্বোধনের পরই অবহেলায় পড়ে যায়। হাতিরঝিলও সেই ধারার ব্যতিক্রম নয়। এই ধরনের উন্নয়ন কেবল নির্মাণে সীমাবদ্ধ থাকলে তা টেকসই হয় না। রক্ষণাবেক্ষণ কাঠামো ও জবাবদিহি থাকতে হয়, না হলে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক সেটাই হচ্ছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, এটা এখন সিটি করপোরেশনের অধীনে আছে, যদিও অবোকাঠামোগত দিকগুলো রাজউক দেখভাল করে। এখন এগুলো এভাবে থাকছে, কারণ তাদের দায়বদ্ধতা নেই, কোনো জবাদিহিতা নেই। যদি বলি বিআরটিসি, বিআরডিএ, বিআরডিসি, সিটি করপোরেশন কোনো সরকারি জায়গায় দায়বদ্ধতা নেই। ফলে এমন হচ্ছে, কোনো সুরহা হচ্ছে না। এখন দরকার জবাদিহিতা। দায়িত্ব অবহেলার কারণে কোনো কর্মকর্তার চাকরি হারাতে হচ্ছে, এটার কোনো নজির বাংলাদেশে নেই। যদি জবাদিহিতা আর দায়বদ্ধতা অথবা চাকরি হারানোর ভয় থাকত তাহলে এই ধরনের অবহেলা করত না। ডিএসসিসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বৃষ্টির পানিতে রাস্তার সংস্কারকাজ দীর্ঘস্থায়িত্ব হারায়। বর্ষাকালে সড়কে জমে থাকা পানি মেরামতকাজের স্তর নষ্ট করে দিয়ে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে প্রলম্বিত বৃষ্টির সময়ে কোনো সংস্কার ও উন্নয়নকাজ শুরু করলে তা টেকসই হওয়ার নিশ্চয়তা থাকে না। বর্ষার কারণে চলমান টেন্ডার প্রক্রিয়া ও মাঠপর্যায়ের প্রস্তুতিও মন্থর ছিল। যদিও টেন্ডার অনুমোদন শেষ হয়েছে, আবহাওয়ার অনিশ্চয়তার ফলে কাজ জোরদার করা সম্ভব হয়নি। এদিকে রাজউক বলছে, টেন্ডার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে সড়ক সংস্কারকাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। বর্ষাকালের কারণে কাজের অনুকূল পরিবেশ না থাকায় পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নেও দেরি হয়। তবে বর্তমানে বৃষ্টিপাত কম হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে থাকা খানা-খন্দ মোকাবিলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেরামত কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে কিছু স্থানে অস্থায়ীভাবে রিপেয়ারিং করে চলাচলে সাময়িক স্বস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে।
হাতিরঝিল প্রকল্প উদ্বোধন হয় ২০১৩ সালে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তৈরি এই প্রকল্প ছিল রাজধানীর অন্যতম সফল নগরায়ণ উদ্যোগ। লেক, সেতু, উড়ালসড়ক, ফুটপাথ, জলাধার সব কিছুই পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধান শেষ হয়ে রাজউকের হাতে দায়িত্ব যাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় অবনতি। শুরুতে সামান্য ত্রুটি দেখা দিলেও সময়ের সঙ্গে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। ফার্মগেট থেকে তেজগাঁও হয়ে রামপুরা পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটারের এই সড়ক এক সময় শহরের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও মনোরম পথ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন তা খানাখন্দে ভরা। রাত নামলেই আলো না থাকার কারণে পুরো এলাকা অন্ধকারে ঢেকে যায়, সুযোগ নেয় ছিনতাইকারীরা। লেকের পানি কালচে হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়, আশপাশে জমে থাকা আবর্জনা আর আগাছায় সৌন্দর্যের কোনো ছাপ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।