নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের আয়োজনে মাসব্যাপী লোক কারুশিল্প ও লোকজ মেলায় আগত দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে। শুক্রবার ছুটির দিনে লক্ষ্য করা গেছে মাসব্যাপী এই লোকজ উৎসবে ছিল উপচে পড়া ভিড়। প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা হাজারো নারী, পুরুষ ও শিশুরা মেলার আনন্দে মেতে ওঠে। আসছে বিদেশি পর্যটকরাও।
ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, প্রাচীন গৌরবময় ও বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। এর বিস্তৃতি অঞ্চল বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। সোনারগাঁ বাংলার ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল প্রাচীন জনপদ। প্রায় তিনশত বছর সোনারগাঁ প্রাচীন বাংলার রাজধানী ছিল। সুলতানী আমলের পটভুমিতে আমাদের সোনালি ঐতিহ্যের দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে বেছে নেয়া হয়েছিল সোনারগাঁকে। মুঘল সুবেদার ইসলাম খানের সময়ে ১৬০৮ সালে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পর সোনারগাঁয়ের গুরুত্ব ম্লান হয়ে যায়। তথাপি সোনারগাঁ আমাদেরকে নিয়ে যায় সোনালি অতীতের কাছে। ঐতিহাসিক সোনারগাঁয়ে অতীত স্মৃতিকে সামনে রেখেই শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আন্তরিক প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় এই গৌরবদীপ্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন যা সোনারগাঁও জাদুঘর নামেও পরিচিত।বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্পের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও পুনরুজ্জীবন করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ সরকার এক প্রজ্ঞাপন বলে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করে।
লোকজ ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন প্রতিবছর এই মেলার আয়োজন করে। এবারের মেলায় গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প এবং খেলাধুলাকে নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরা হয়েছে।
মেলায় রয়েছে ১০০টি স্টল, যেখানে বিভিন্ন পল্লী অঞ্চল থেকে আসা কারুশিল্পীরা তাদের তৈরি হস্তশিল্প প্রদর্শন ও বিক্রির ব্যবস্থা করেছেন। রাজশাহীর শখের হাঁড়ি, চট্টগ্রামের নকশিপাখা, সোনারগাঁয়ের কাঠের পুতুল ও নকশিকাঁথা, মুন্সিগঞ্জের শীতলপাটি এবং বান্দরবান ও রাঙামাটির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কারুপণ্য মেলার প্রধান আকর্ষণ। এছাড়াও পুতুল নাচ, বায়োস্কোপ প্রদর্শনী এবং নাগরদোলার মতো ঐতিহ্যবাহী বিনোদনের ব্যবস্থা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করছে। পাশাপাশি, গ্রামীণ খেলার মধ্যে রয়েছে হাডুডু, কাবাডি, ঘুড়ি উড়ানো এবং বউ সাজানো প্রতিযোগিতা।
মেলায় প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত লোক সংগীত এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দলীয় লোক সংগীত ও লোকনৃত্যের পরিবেশনা করা হচ্ছে। এই আয়োজন লোকসংস্কৃতির রঙিন দিকগুলো নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরছে।
মেলায় আসা দর্শনার্থীরা কারুপণ্য কেনার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী লোকজ বিনোদন উপভোগ করছেন। মেলায় ঘুরতে আসা এক দর্শনার্থী বলেন, “এখানে এসে হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। নতুন প্রজন্মের জন্য এমন মেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
এছাড়াও প্রতি বছরের মতো এবারও মেলায় হাতে তৈরি বিভিন্ন রকমের আকর্ষণীয় পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের চারু কারু শিল্পীগণ। এ বছর মেলায় দুই লক্ষাধিক পর্যটক ও দর্শনার্থী সমাগম ঘটবে বলে আশা করছেন আয়োজকবৃন্দ।
তবে সার্বজনীন টিভি কিংবা স্যাটেলাইট চ্যানেল যুগের আগে ছোট কিংবা বড়দের দেশ-বিদেশের নানা ঘটনা আর স্থাপত্যশৈলী দেখার জনপ্রিয় মাধ্যম ছিলো বায়োস্কোপ। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন উৎসব আর মেলায় দেখা মিলতো হাতে ডুগডুগি বাজিয়ে সং সেজে গীতিকাব্যের ছলে বায়োস্কোপওয়ালা বিভিন্ন রঙে মাখা বায়োস্কোপের হাতল ঘুরাচ্ছে আর ছোট ছোট কাচের ফুটো দিয়ে শিশু থেকে শখের বশে বড়রা পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা সংবলিত চিত্র দেখছে বায়োস্কোপের ভিতর। এক সময়ের জনপ্রিয় এই বিনোদন শিল্প বর্তমানে অনেকটা বিলীনের পথে থাকলেও প্রতিবছর এর দেখা মিলে এই সোনারগায়ের মাসব্যাপী লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর মেলায়।
মেলায় ঘুরতে আসা আরেক দর্শনার্থী বলেন, ছোটবেলায় বায়োস্কোপ দেখেছিলাম একবার। আবার দেখলাম এই মেলায় এসে, সময়ের চাহিদায় যা দেখায় তার চাহিদা না থাকলেও প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য বায়স্কোপের প্রতি আকর্ষণ বরাবরই রয়েছে।
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক আবুল কালাম মোঃ আজাদ সরকার বলেন, “প্রতি বছর আমরা চেষ্টা করি মেলায় নতুন কিছু যুক্ত করার। ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের প্রচুর ভিড় দেখা যায়, আজও দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় দেখে খুব ভালো লাগছে। আশা করছি, মেলার শেষ দিন পর্যন্ত এমন প্রাণবন্ত পরিবেশ বজায় থাকবে।”
মাসব্যাপী লোক ও কারুশিল্প মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত উন্মুক্ত থাকবে। ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলমান এই উৎসব সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং বিনোদনের এক অসাধারণ মিলনমেলা হয়ে উঠেছে।


























