১০:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ৯ পৌষ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব ও সাংবিধানিক সংস্কার: গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠন ভাষা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও নাগরিক মর্যাদার সংগ্রামের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১–এর স্বাধীনতা পর্যন্ত প্রতিটি উত্তরণেই ছিল ভাষাগত পরিচয়, ন্যায়ভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। স্বাধীনতার পর সংবিধান জাতীয় পরিচয়ের নতুন ভিত্তি গড়ে দেয়। তবে সময়ের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা, নাগরিক অধিকার ও সাংবিধানিক চর্চা নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাম্প্রতিক প্রস্তাবগুলো তাই রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব, বহুত্ববাদ ও সাংবিধানিক সংস্কারের নতুন দিক উন্মোচন করছে, যা শুধুই আইনি সংশোধন নয়—বরং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় ভারসাম্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী উপাদান।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং মাতৃভাষার সহাবস্থান

বর্তমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩–এ রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’। ভাষা আন্দোলনের অর্জন হিসেবে এটি আমাদের সাংবিধানিক পরিচয়ের মূল ভিত্তি। তবে বহুভাষিক সমাজে নৃ–গোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে ‘জাতীয় প্রচলিত ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদকে শক্তিশালী করবে। UNESCO (2005) ও UN Declaration on the Rights of Indigenous Peoples (2007) মাতৃভাষার সাংস্কৃতিক অধিকারকে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতালসহ বহু ভাষা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। গবেষণা বলছে—স্বীকৃতি না থাকলে পরিচয় সংকট ও সাংস্কৃতিক ক্ষয় ত্বরান্বিত হয়। তাই রাষ্ট্রভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষার সাংবিধানিক গ্রহণযোগ্যতা সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

নাগরিকত্বের পরিচয়: অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘বাংলাদেশি’ সত্তা

নাগরিক পরিচয় হিসেবে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটিকে সাংবিধানিকভাবে পুনঃনির্ধারণের প্রস্তাব রাষ্ট্রীয় একাত্মতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জন রলসের মতে, নাগরিকত্ব সামাজিক চুক্তির প্রতীক, যা সবাইকে সমান মর্যাদায় যুক্ত করে। জাতিগতভাবে নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক নাগরিক পরিচয় গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে মজবুত করবে এবং জাতীয় পরিচয়কে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে।

দ্বিকক্ষ সংসদের দুই–তৃতীয়াংশ সমর্থন: ভারসাম্যের সংস্কার

সংবিধান সংশোধনে দুই কক্ষের (উচ্চ ও নিম্নকক্ষ) দুই–তৃতীয়াংশ সমর্থন আবশ্যক করার প্রস্তাব বহু দেশের উন্নত সংসদীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বলে, দ্বিকক্ষ ব্যবস্থা আইন প্রণয়নকে সুগভীর করে এবং নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিহত করে। দীর্ঘদিনের নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসন ও সংসদীয় কার্যকারিতার সংকট মোকাবিলায় এই সংস্কার প্রয়োজনীয় ভারসাম্য আনতে পারে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংশোধনে গণভোট

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংশোধনে গণভোট বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব জনগণের সরাসরি মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডসহ অনেক দেশে সাংবিধানিক সংস্কারে গণভোট অপরিহার্য। ভারতের বিখ্যাত Kesavananda Bharati মামলাও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনে জনগণের ইচ্ছাকে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও আস্থাহীনতার প্রেক্ষাপটে গণভোট একটি যৌক্তিক সমাধান।

সংবিধানের ৭ক ও ৭খ বাতিল: প্রয়োজনীয় নমনীয়তা

৭ক ও ৭খ সংবিধানকে অতিরিক্ত কঠোর (‘rigid constitution’) করে তুলেছে, যার ফলে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারে বাধা সৃষ্টি হয়। বিশ্বে যুক্তরাজ্যের মতো নমনীয় সংবিধান বা জার্মানির মতো মৌলিক কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে পরিবর্তনযোগ্য সংবিধান—দুই ব্যবস্থাই কার্যকর। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সংবিধানের প্রয়োজনীয় নমনীয়তা রাজনৈতিক অভিযোজন নিশ্চিত করবে।

অনুচ্ছেদ ১৪১ক সংশোধন: জরুরি অবস্থার অপব্যবহার রোধ

‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ শব্দবন্ধ জরুরি অবস্থা ঘোষণায় রাজনৈতিক ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি করে। ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতার প্রতি হুমকি, মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’—এভাবে জরুরি অবস্থার সীমিত ও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা ICCPR–এর নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং অপব্যবহার রোধে কার্যকর।

উপসংহার

বাংলাদেশের গণতন্ত্র সময়ের সঙ্গে অভিযোজিত ও পরিশীলিত হতে পারে—এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। রাষ্ট্রভাষার অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বীকৃতি, সমতাভিত্তিক নাগরিকত্ব, দ্বিকক্ষীয় ঐকমত্য, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় গণভোট, জরুরি অবস্থার অপব্যবহার রোধ এবং সাংবিধানিক নমনীয়তা—সব মিলিয়ে এই সংস্কারসমূহ দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে ভাষাগত বহুত্ববাদ সংরক্ষিত হবে, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, দুর্নীতি কমবে এবং সংবিধানের প্রতি জনআস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে।

লেখক: শিক্ষক।

জনপ্রিয় সংবাদ

একনেক সভায় ৪৬ হাজার ৪১৯ কোটি টাকার ২২ প্রকল্প অনুমোদন

রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব ও সাংবিধানিক সংস্কার: গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় নতুন দিগন্ত

আপডেট সময় : ০৪:১১:০৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠন ভাষা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও নাগরিক মর্যাদার সংগ্রামের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি হয়েছে। ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১–এর স্বাধীনতা পর্যন্ত প্রতিটি উত্তরণেই ছিল ভাষাগত পরিচয়, ন্যায়ভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামো ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। স্বাধীনতার পর সংবিধান জাতীয় পরিচয়ের নতুন ভিত্তি গড়ে দেয়। তবে সময়ের সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা, নাগরিক অধিকার ও সাংবিধানিক চর্চা নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাম্প্রতিক প্রস্তাবগুলো তাই রাষ্ট্রভাষা, নাগরিকত্ব, বহুত্ববাদ ও সাংবিধানিক সংস্কারের নতুন দিক উন্মোচন করছে, যা শুধুই আইনি সংশোধন নয়—বরং গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় ভারসাম্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী উপাদান।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং মাতৃভাষার সহাবস্থান

বর্তমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩–এ রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’। ভাষা আন্দোলনের অর্জন হিসেবে এটি আমাদের সাংবিধানিক পরিচয়ের মূল ভিত্তি। তবে বহুভাষিক সমাজে নৃ–গোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে ‘জাতীয় প্রচলিত ভাষা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদকে শক্তিশালী করবে। UNESCO (2005) ও UN Declaration on the Rights of Indigenous Peoples (2007) মাতৃভাষার সাংস্কৃতিক অধিকারকে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলাদেশে চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতালসহ বহু ভাষা বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। গবেষণা বলছে—স্বীকৃতি না থাকলে পরিচয় সংকট ও সাংস্কৃতিক ক্ষয় ত্বরান্বিত হয়। তাই রাষ্ট্রভাষার পাশাপাশি মাতৃভাষার সাংবিধানিক গ্রহণযোগ্যতা সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

নাগরিকত্বের পরিচয়: অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘বাংলাদেশি’ সত্তা

নাগরিক পরিচয় হিসেবে ‘বাংলাদেশি’ শব্দটিকে সাংবিধানিকভাবে পুনঃনির্ধারণের প্রস্তাব রাষ্ট্রীয় একাত্মতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জন রলসের মতে, নাগরিকত্ব সামাজিক চুক্তির প্রতীক, যা সবাইকে সমান মর্যাদায় যুক্ত করে। জাতিগতভাবে নিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক নাগরিক পরিচয় গণতান্ত্রিক ভিত্তিকে মজবুত করবে এবং জাতীয় পরিচয়কে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে।

দ্বিকক্ষ সংসদের দুই–তৃতীয়াংশ সমর্থন: ভারসাম্যের সংস্কার

সংবিধান সংশোধনে দুই কক্ষের (উচ্চ ও নিম্নকক্ষ) দুই–তৃতীয়াংশ সমর্থন আবশ্যক করার প্রস্তাব বহু দেশের উন্নত সংসদীয় ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বলে, দ্বিকক্ষ ব্যবস্থা আইন প্রণয়নকে সুগভীর করে এবং নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতার অপব্যবহার প্রতিহত করে। দীর্ঘদিনের নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বায়ত্তশাসন ও সংসদীয় কার্যকারিতার সংকট মোকাবিলায় এই সংস্কার প্রয়োজনীয় ভারসাম্য আনতে পারে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংশোধনে গণভোট

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংশোধনে গণভোট বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব জনগণের সরাসরি মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডসহ অনেক দেশে সাংবিধানিক সংস্কারে গণভোট অপরিহার্য। ভারতের বিখ্যাত Kesavananda Bharati মামলাও সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনে জনগণের ইচ্ছাকে অপরিহার্য বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট ও আস্থাহীনতার প্রেক্ষাপটে গণভোট একটি যৌক্তিক সমাধান।

সংবিধানের ৭ক ও ৭খ বাতিল: প্রয়োজনীয় নমনীয়তা

৭ক ও ৭খ সংবিধানকে অতিরিক্ত কঠোর (‘rigid constitution’) করে তুলেছে, যার ফলে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্কারে বাধা সৃষ্টি হয়। বিশ্বে যুক্তরাজ্যের মতো নমনীয় সংবিধান বা জার্মানির মতো মৌলিক কাঠামো অপরিবর্তিত রেখে পরিবর্তনযোগ্য সংবিধান—দুই ব্যবস্থাই কার্যকর। বাংলাদেশের বাস্তবতায় সংবিধানের প্রয়োজনীয় নমনীয়তা রাজনৈতিক অভিযোজন নিশ্চিত করবে।

অনুচ্ছেদ ১৪১ক সংশোধন: জরুরি অবস্থার অপব্যবহার রোধ

‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ শব্দবন্ধ জরুরি অবস্থা ঘোষণায় রাজনৈতিক ব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি করে। ‘রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতার প্রতি হুমকি, মহামারি বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ’—এভাবে জরুরি অবস্থার সীমিত ও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা ICCPR–এর নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ এবং অপব্যবহার রোধে কার্যকর।

উপসংহার

বাংলাদেশের গণতন্ত্র সময়ের সঙ্গে অভিযোজিত ও পরিশীলিত হতে পারে—এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। রাষ্ট্রভাষার অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বীকৃতি, সমতাভিত্তিক নাগরিকত্ব, দ্বিকক্ষীয় ঐকমত্য, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় গণভোট, জরুরি অবস্থার অপব্যবহার রোধ এবং সাংবিধানিক নমনীয়তা—সব মিলিয়ে এই সংস্কারসমূহ দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে ভাষাগত বহুত্ববাদ সংরক্ষিত হবে, ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, দুর্নীতি কমবে এবং সংবিধানের প্রতি জনআস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে।

লেখক: শিক্ষক।