বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন-বাংলাদেশের নারী অধিকার আন্দোলন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে। জানিয়েছেন কিভাবে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন আজকের রোকেয়া কবীর। তার একান্ত সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক সবুজ বাংলা’র নিজস্ব প্রতিবেদক তাসকিনা ইয়াসমিন।
পর্ব – ১
আমি এসএসসি পাস করেছি নেত্রকোনা গভর্নমেন্ট গার্লস কলেজ থেকে। নেত্রকোণা শহর থেকে নদী পার হলে সেখানেই আমার বাড়ি। সুতরাং গ্রামীণ পরিবেশ। নদীটা পার হলেই শহর। সুতরাং বলা যায়, আমি গ্রামের মেয়ে। যদিও আমি গ্রামে বড় হয়েছি, শহরেই পড়াশোনা। শহরেই মিটিং মিছিল, খেলাঘর করা। যেহেতু আমার বাবার জমি একটু বেশি ছিল তাই আমাদের সকলের উচ্চশিক্ষা ঢাকায় হয়েছে। আমাদের সব ভাইবোনেরা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা এবং রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছি। আমরা নয় ভাইবোন। কৃষিজমি থেকে যে আয়টা হতো সেখান থেকেই এই পড়াশোনার খরচ বহন করা হতো। তখন তো পাটের রমরমা বিষয় ছিল। পাকিস্তানের মূল রপ্তানি আয় হতো পাট থেকে। নেত্রকোণা ছিল পাট উৎপাদনের একটা অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। সুতরাং সেটাই আমাদের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য সাহায্য করেছে। সে জন্য আমরা ভাইবোনরা সবাই মোটামুটিভাবে শিক্ষার সুযোগ পেয়েছি।
আমার বড় চার ভাই, এক বোন। ছোট এক বোন এবং দুই ভাই। মোট নয় ভাইবোন আমরা। আমার মেজ ভাই গোলাম মর্তুজা খান। তিনিই সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং তার অভিভাবকত্বেই আমরা সব ভাইবোন ধীরে ধীরে রাজনীতিতে জড়াই। আর একটা বিষয় ছিল যে, নেত্রকোনায় প্রগতিশীল আন্দোলন ছিল। এটা হিন্দু অধ্যূষিত এলাকা ছিল বলে এখানে ব্রিটিশ আমল থেকেই বামপন্থী রাজনীতির একটা আবহ ছিল। যদিও আমি গ্রামে বড় হয়েছি, গ্রামীণ পরিবারগুলোর বিষয়গুলো আমি এবং আমার ভাইবোনেরা খুব একটা পাইনি। বিশেষ করে আমাদের তিনবোনের গ্রামের কোন বাড়িতে যাতায়াতের কোন সুযোগ দেয়া হতো না। নিষেধ ছিল। সুতরাং স্কুল এবং স্কুলের বন্ধুদের পরিবার এগুলোর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল।
আমার বরেণ্য শিক্ষকেরা। তাদের কাছেই মানুষ হওয়ার মন্ত্র শিখেছি। আমাদের তখন শুধু ক্লাসের পড়া পড়তে দেয়া হতো। বাইরের বই পড়তে দেয়া হতোনা। তখন আমার ভাই গোলাম মোস্তফা কলকাতা থেকে দুইটা পত্রিকা আনাতেন। ভাইদের পড়া শেষ হলে সেগুলো আমরা গোগ্রাসে পড়তাম। ক্লাস সিক্সে যখন পড়ি, আমাদের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন নৃপেন্দ্র কুমার চক্রবর্তী। উনি আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, বলত, যাযাবরের দৃষ্টিপাতের নায়কের নাম কি? তখন তো উপন্যাস পড়া আমাদের নিষিদ্ধ। আউট বই মানে তো উপন্যাস। আমরা বড়জোড় ভাইয়ের ম্যাগাজিন আর কিছু রহস্য উপন্যাস পড়ার সুযোগ পেতাম। এগুলো চুরি করে পড়তাম। আর পড়ে খুবই ভয় পেতাম। তারপরে কিভাবে শিশু অপহরণ করে নিয়ে পাতিলের মধ্যে ভরে রেখে তাকে পঙ্গু বানাত এরপর তাকে দিয়ে ভিক্ষা করাত। এই ধরণের বই পড়ে আমার খুব কষ্ট হতো!
আমাদের ইংরেজির শিক্ষক যে জিজ্ঞেস করলেন, আমরা তখন বুঝিনি, পরে বুঝলাম যে আমরা যেন বইটা পড়ার সুযোগ পাই। তাই এটা জিজ্ঞেস করেছেন। আর একটু বড় হয়ে এটা বুঝলাম। এটা আসলে উৎসাহ দেয়া। তখনকার নামকরা বইগুলো যে ছিল, সেগুলো পড়ার জন্য দিত। প্রথম ৮/১০ দিন তো যায় বই কেনা এগুলো করতে। ক্লাসে শিক্ষক যায় কিন্তু সেভাবে ক্লাস শুরু হয় না। সাবজেক্টের থেকে অন্যান্য আলাপ আলোচনা বেশি হতো। নৃপেন্দ্র স্যার, আরেকদিন বললেন, তোরা কি ঐকিক নিয়ম শিখেছিস। আমরা বললাম খুব শিখেছি। একটা ঐকিক নিয়মের অংক দিলেন। তিনজন মাঝি ১০ মাইল দূরত্ব এতঘন্টায় যেতে পারে। এখন সেই সময়টা কমিয়ে আনার জন্য কি করতে হবে। আমরা বললাম মাঝির সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হবে। ১০ মিনিটে ঐ দূরত্ব পার হতে হলে কতজন মাঝি দরকার হবে। আমরা খুব খুশি হয়ে মাঝির সংখ্যা বাড়িয়ে দিলাম। যেটা ঐকিক নিয়মে আসে। খুব খুশি। এবার স্যার জিজ্ঞেস করলেন, বল তোরা। এবার স্যার বললেন, এই যে তোরা এত মাঝি বাড়ালি তোরা কি জানিস, নৌকার সাইজটা কি? এত মাঝি ধরবে কিনা? তখন আবার আমরা নৌকার সাইজটা বড় করে দিলাম। ঠিক আছে স্যার, তাহলে আমরা বড় নৌকা নিব যাতে এতগুলো মাঝি ধরে। এবার স্যার বললেন, তোরা কি জিজ্ঞেস করেছিস, যে এই নৌকাটা খালের মধ্যে দিয়ে যাবে নাকি নদী দিয়ে যাবে? এটা ছোট নদী নাকি বড় নদী? স্রোতের উল্টো দিকে যাবে, নাকি স্রোতের দিকে যাবে এই কথাগুলো জিজ্ঞেস করেছিস। এই যে শিক্ষাটা ঐকিক নিয়ম দিয়েই সমস্ত সমস্যার সমাধান হবে না। পার্সপেক্টিভ বোঝা, কনটেক্স বোঝা এটা কিন্তু উনি আমাদের ঐ এক ঐকিক নিয়ম করতে দিয়েই বুঝিয়ে দিলেন।
আরেকদিন তিনি বললেন, ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এটার ইংরেজি কি হবে? তারপর জিজ্ঞেস করলেন তোদের কি জিওগ্রাফি ক্লাস শুরু হয়েছে? বললাম না। তাহলে কেউ যদি এসে জিজ্ঞেস করে ঢাকা কোথায় অবস্থিত? তখন তোরা কি বলবি না যে, স্যার বা আপা আমাদের জিওগ্রাফি ক্লাস এখনও শুরু হয়নি। তাই আমরা শিখতে পারিনি। উনি দেখিয়ে দিলেন যে, ইংরেজি ট্রানস্লেশনের মধ্যেই কিন্তু এই শিক্ষাটা পেয়ে গেছি আমরা। ঢাকা কোথায় অবস্থিত। এই যে শিক্ষাগুলো তারা দিয়েছেন। এই শিক্ষাগুলো এখন পর্যন্ত মনে গেঁথে গেছে। তাদের এই শিক্ষা আমাদের জীবনে দিক নির্দেশনা দিয়েছে।
আমি ৬৬ এ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করি। বদরুন্নেসা কলেজে ভর্তি হই। এখানে শেখ হাসিনা পড়াশোনা করেছেন। হোস্টেলে থাকলাম। তখন ইডেন কলেজের হোস্টেল ছিল। তখন ঐ হোস্টেলে আমাদের মেয়েরা থাকতে পারত। তখন ইডেনে ইন্টারমিডিয়েট শাখাটা ছিল না। এই কলেজটাকেই ইডেনের ইন্টারমিডিয়েট হিসেবে ধরা হতো। সেখানে এসেই সক্রিয়ভাবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হই। পরবর্তীতে কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদিকা হই। হাসিনা আপা যে কেবিনেটের ভিপি হয়েছিল সবাই ছাত্রলীগের ছিল। আমিই একমাত্র ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হই। অন্য সব পদে আওয়ামীলীগ নির্বাচিত হয়। কারণ আমি হোস্টেলে থাকতাম। আমি মেয়েদের সমস্যা নিয়ে হোস্টেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেন দরবার করা এগুলো করতাম। সেই কারণে মেয়েদের কাছে আমার জনপ্রিয়তা ছিল। সেই কারণে হোস্টেলের একচেটিয়া ভোটগুলো আমি পাওয়ার ফলে, ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হই।


























