স্বাধীন বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় যেসব নারী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মাহমুদা চৌধুরী। তিনি চল্লিশ বছর ধরে এই পেশায় থেকে পেশাকে সমৃদ্ধ করেছেন। দীর্ঘ সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে পেরিয়েছেন নানা চড়াই-উৎরাই। তিনি একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন, তার জীবনের না বলা অনেক কথা। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন দৈনিক সবুজ বাংলা’র রিপোর্টার তাসকিনা ইয়াসমিন। আজ থেকে ধারাবাহিকভাবে তার সাক্ষাতকার ছাপা হচ্ছে।
আমাদের সাংবাদিকতায় আমাদের মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার প্রধান বাধাই হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিকতা
পুরুষতান্ত্রিকতা আমাদের মেয়েদের মধ্যেও আছে। পুরুষদের মধ্যে আছে। ছেলেরা এখন বের হতে পারেনি এর থেকে। তার মধ্যে আর একটা যুক্ত আছে পুঁজিবাদী সমাজের যে ভোগলিপ্সা এটা ছেলেদের মধ্যেও আছে মেয়েদের মধ্যেও আছে। এটা আমি বলি যে, এটা নতুন একটা উপদ্রব।
একে তো পুরুষতন্ত্র তার উপরে পুঁজিবাদী ভোগবাদ। ভোগবাদ আমাদের নারী সাংবাদিক এবং পুুরুষ সাংবাদিক দুজনের মধ্যেই ভর করেছে যার ফলে আমরা সেভাবে মেয়েদের আর দেখতে পাচ্ছিনা। অন্যরকম একটা ঝলসে উঠা মেয়ে আমরা পাচ্ছিনা। এর জন্য দায়ী মালিক পক্ষ, দায়ী মেয়েদের কম পড়াশোনা। আমাদের মেয়েদের নারীবাদের উপর কোন আগ্রহ নেই। জানার শেখার আগ্রহ নেই। তারা জেন্ডারটা বোঝে কিন্তু নারীবাদটা বোঝে না। আমাদের মেয়েরা যেদিন সত্যিকারের দীক্ষা নেবে সেদিন আমি মনে করি আমাদের মেয়েরা সত্যিকারের মানুষ হবে। আর তখন কোন সমস্যাই থাকবে না আমাদের মধ্যে। আমাদের সাংবাদিকতায় এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে। আমাদের নারী সম্পাদক আছেন কিন্তু তারা তো পুুরুষতন্ত্রের ভাবাদর্শ ধারণ করেই আছেন। তারা যোগ্য যদিও সবাই স্বামীর নামে, স্বামীর সহযোগিতায় এগিয়েছেন। আমাদের মতো লড়াকু নারী না, কারো সহযোগিতা ছাড়া, লড়াই করে এগিয়েছে। এইরকম তারা না, পিছনে তাদের স্বামী আছেন। ধরো, ইত্তেফাকের তাসমিমা হোসেন কিন্তু দেখ তার হাজব্যান্ড আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। মাহবুবা চৌধুরী মানবজমিনের সম্পাদক তিনি স্বামীর মাধ্যমে। দুজন নারীকে আমরা স্বামীর মাধ্যমে পেয়ে যাচ্ছি। তারপর যুগান্তরের সালমা ইসলাম। সবাই কিন্তু ঐভাবে। কিন্তু লড়াকু নারীদের মধ্যে থেকে যারা নাকি মাঠে কাজ করছে এই সব নারীদের কেন আমরা পাচ্ছিনা? নিয়োগ কেন দিচ্ছেনা সম্পাদক হিসেবে?
সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন না থাকলে আজকের নারী লেখকদের আমরা পেতাম না
পৃথিবীর উৎপাদন প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার খাতিরে একটি জাতিকে এগিয়ে নেয়ার খাতিরে কেন আমি বাড়তি সুবিধা পাব না, বলো? আমার তো পেতে হবে। আমার বেশি অধিকারগুলো চাই। আমার একটা আলাদা বাথরুম চাই। আলাদা রেস্টরুম চাই। কাজের সুযোগ এবং বেশি বেশি ট্রেনিং চাই। সেইসঙ্গে বিভিন্ন বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পেতে চাই। লিডারশীপের ট্রেনিংগুলোতে মেয়েদের যাবার সুযোগ চাই। একজন তরুণ মেয়ে যদি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটা বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ পায় তাহলে তার দৃষ্টিভঙ্গি বাড়বে। নতুন মেয়েদের জন্য এবং পুরনো মেয়েদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ট্যুরে আলাদা কোটা থাকা দরকার। কত মেয়ে সাংবাদিকতায় আছে তার একটা তালিকা থাকা দরকার। প্রেস ইনস্টিটিউট এই তালিকা করতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে আকতার জাহান মালিকের একটা লেখা বেরিয়েছে সেখানে আমারই নাম নেই। বিসিডিজেসিতে একটা তালিকা করা হয়েছে সেখানে আমার নামনেই। দীর্ঘদিন রিপোর্টিং করছি দৈনিক দিনকালে, সেখানে আমার নাম বাদ দিয়ে নতুন চারজন মেয়ের নাম দেওয়া হয়েছে। জাহ্নবী দাশ, মুন্নী সাহা, পারভীন এবং আর একজন। এই চারজনের নাম আছে। অথচ আমি কতবছর আগে থেকে রিপোর্টিংয়ে আছি আমার নাম আসেনি।
রোজী ফেরদৌস বা হাসিনা আশরাফ আপার নাম আসেনি। কিন্তু আমি তো ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট ছিলাম। ধর্মঘট থেকে শুরু করে রাজনীতি, সিটি কর্পোরেশন, নির্বাচন কমিশন, ক্রাইম রিপোর্ট, অর্থনৈতিক, কৃষি, অনুসন্ধানী রিপোর্ট, থেকে শুরু করে সব রিপোর্টই আমি করেছি। ব্যক্তিগতভাবে সবাই আমাকে পছন্দ করে কিন্তু আমার নামই তারা দেয়নি। আমি কারো ক্ষতি করিনি, কারো প্রতি আমার কোন জেলাস নেই।
আমি মনে করি, মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন যদি না থাকতেন তাহলে বাংলাদেশের মেয়েরা সত্যি আজকে এই পর্যায়ে আসতে পারত না। আর দ্বিতীয় হচ্ছে নাঈমুল ইসলাম খান। এই দুজনকে আমি মনে করি নারীবান্ধব সম্পাদক। যারা নারী সাংবাদিক তৈরি করেছে। আবার নারীদের যথেষ্ট এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করেছে। মোহাম্মদ নাসিরুদ্দীন সাহিত্যচর্চায় নারীদের নিয়োজিত থেকেছেন যথেষ্ট সুযোগ দিয়েছেন। আজকে রিজিয়া রহমান, রাবেয়া খাতুন থেকে শুরু করে ড. নীলিমা ইব্রাহীম প্রত্যেকের লেখা বেগম এ প্রকাশিত হতো।
আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে হীনমন্যতা আমাদের পিছিয়ে রাখে। আমাদের শত্রু আমরা নিজেরাই, যেমন পুুরুষতান্ত্রিকতা আমাদের শত্রু, তেমনি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক নারীরা আমাদের পিছনে টেনে রাখছে।
আমি দিনকালে ডিপ্লোম্যাটিক বিটে কাজ করছি। আমি একটা যায়গায় লেগে থেকেছি কারণ আমি বিশ্বাস করি যায়গা বদলালেই সবকিছুর পরবির্তন হবে না। আমি আমার মেয়েদের বলব। তোমরা যে যায়গায় আছ সেই যায়গাটায় থেকেই লড়াই করো। তুমি তোমার যায়গাটা শক্ত করে। কিন্তু নতুন যায়গায় বদলালে হয় কি? নতুন যেখানে তুমি যাচ্ছ তাদের তুমি চেন না। পুরনো যায়গায় তুমি জেনে গেছ, এ আমার শত্রু, এর সঙ্গে আমাকে এভাবে চলতে হবে যে আমার মিত্র না তার সঙ্গে আমাকে এভাবে চলতে হবে। কখন কি করা লাগবে তা তোমার মাথায় ঠিক করা আছে। কিন্তু নতুন যায়গায় গিয়ে কে কিভাবে তোমার সঙ্গে চলবে তা তুমি জাননা। নারীর মামা, চাচা, খালা, থাকতে হবে, না হলে এগিয়ে যেতে পারবে না। এটা নারী সাংবাদিকের একটা পেইন।
টিভিতে সব মেয়েরা অল্প বয়সী সুন্দর মেয়ে থাকতে হবে। বিসিডিজেসি থেকে নিয়ে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে। কয়েকটা টিভি চ্যানেল আমরা ভিজিটে যাই। সেখানে বয়স্ক নারীরা খবর পড়ছে। সত্তোরোর্ধ্ব নারী। প্রডাকশন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বললাম। প্যান্ট, শার্ট পরে সত্তোরোর্ধ্ব নারীরা কাজ করছে। তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমি কথা বললাম। একজন সাংবাদিক আমাকে বললেন, আমি এখন ফ্রি হয়ে কাজ করছি। ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে। এখন আর পিছুটান নেই। আমাদের দেশে কিন্তু সিনিয়র মেয়েদের কোন চান্সই দেয়না। তাদের দেশে বয়সের কোন বার নেই।
এ ব্যাপারে এক নারী সাংবাদিক আমাকে বলল যে, আমাদের বার ছিল। কয়েক দশক আগে। ইয়ং, গ্ল্যামারার্স হতে হবে। ৩ দশক আগে মেয়েরা গণমাধ্যমে কাজ করতে এসে খুব এবিউজের শিকার হতো। এখন নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ এরা নারীদের পক্ষে।
মেয়েরা স্কার্ট পরে, টপস পরে কাজ করছে। আমি বলি তা ঠিক না। কারণ, কর্মপরিবেশে একেক জনের মন মানসিকতা একেক রকম। আমি এমন পোশাক পরব না, যার কারণে আমার সঙ্গে যারা কাজ করছে তারা যেন বিব্রত না হয়।
মেয়েদের কিছুটা বদলাতে হবে। শাসক নারী হওয়া সত্ত্বেও এখন নারীর নিপীড়ন বন্ধ হচ্ছে না। আমি যখন মাঠে কাজ করি, তখন একজন অনেক বড় মাপের সাংবাদিক আমাকে বলেন যে মাহমুদা তোমার কি ঘরে মন টেকেনা? তুমি এখন ডেস্কে কাজ করো। আমি বললাম আপনি একজন কমিউনিস্ট। কমিউনিস্ট হয়ে এসব কি কথা বলেন?
তখন বলে যে, আসলে কি স্বামীর সঙ্গে তোমার কোন মিলমিশ নাই? নারী সাংবাদিকদের সহকর্মীরা এভাবেই মূল্যায়ণ করে!
আজ নারীদের গণপরিবহনের দিকে কেউ দৃষ্টি দেয়নি। প্রতিবন্ধী নারীর উন্নয়নে কেউ নজর দেয়নি। এগুলো ঠিক করাতো রাষ্ট্র প্রধানের দায়িত্ব আমাদের তো একসময় বলত, রিপোর্টিংটা মেনস জব। আমাকে বলত তুমি কেন এই পেশায় এসেছ। এটা তো মেনস জব।
৩০-৪০ বছর আগে মেয়েদের নিয়ে অনেক বাজে রিপোর্ট পত্রিকায় ছাপা হতো। মুক্তি, উনি কলকাতার মেয়ে ছিলেন। আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের বউ। উনি আত্মহত্যা করলেন। যেকোন কারণেই হোক উনি বাংলাদেশে চলে আসেন। তবে উনি অনেক ভাল একটা কাজ করেছিলেন। তিনি ছেলেটার ভারতে পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই সময় সিলেট থেকে করা রিপোর্ট দিনকালে ছাপা হয়েছিল। যে উনি আত্মহত্যা করেছেন। উনার চরিত্র ভাল ছিলনা, উনি প্রস্টিটিউশনে যুক্ত ছিলেন। আমি এই নিউজটা পড়ে এত ক্ষেপে গিয়েছিলাম। আমি খুব হৈ হুল্লোড় করেছি মফস্বল সাংবাদিকরা এমন কথা কেন লিখবে? আমার ঔদ্ধত্ব্য অফিস হয়ত পছন্দ করেনা। কিন্তু তারপর আমি বলেছিলাম। আমি বললাম, উনাকে এখনই ফোন লাগান এবং জিজ্ঞেস করেন উনি কি করে বললেন যে, উনি প্রস্টিটিউশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন? এইরকম কথা সে কি করে লিখে? ঐ সাংবাদিক সিলেট চিফ ছিলেন। পরে যখন সে ঢাকা অফিসে আসল তখন তাকে বললাম যে, শোন তোমার কিন্তু মেয়ে আছে। তুমি যে এইরকম কথা লিখেছ। তোমার মেয়ে নিয়ে এভাবে লিখবে না সেটা তুমি কি করে বলো? তখন সে বলে আপা আমি একলা না, আমাদের আর কয়েকজন সাংবাদিক এভাবে লিখেছে তাই আমি লিখেছি। তখন আমি বললাম, খবরদার না জেনে শুনে এমন কথা আর কখনও লিখবেন না।
মগবাজারের দিলু রোডে এক পুলিশ অফিসারের বউ আত্মহত্যা করেছিল, তখন পত্রিকায় সাংবাদিক লিখেছিল, ঐ নারী চরিত্রহীন ছিল তাই সে আত্মহত্যা করেছে। পুরুষদের মনোভাবটা এই ঘটনাগুলোর মধ্যে দিয়ে বোঝা যায়।
সমাপ্ত।


























